ইংল্যান্ডে গৃহযুদ্ধের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করো।
পৃথিবীর ইতিহাসে বহু তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার মতো সপ্তদশ শতকের ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের প্রকৃতি বা চরিত নিয়েও ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায় । একদল ঐতিহাসিক মনে করেন যে এই গৃহযুদ্ধ ছিল প্রধানত ভাবাদর্শগত সংঘাত । এই সংখাতের চরম পরিণতি ছিলে একটি পিউরিটান বিপ্লব । এক্ষেত্রে তারা 'শ্রেণীসংগ্রামের বিষয়টি উপেক্ষা করেছেন । ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে সামাজিক কাঠামোতে যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল তাদের রচনায় তা স্থান পায়নি । অন্যদিকে গৃহযুদ্ধ ছিল মূলত শ্রেণীসংগ্রাম আর মই মতকে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়েছেন অপর এক শ্রেণীর ঐতিহাসিক । বলা বাহুল্য এদের চিন্তাভাবনায় রচনায় কালমার্কসের প্রভাব অন্তত্য প্রখট । এরা মনে করেন তৎকালীন ইংল্যান্ডের দুটি প্রধান সামাজিক শ্রেণী জেন্ট্রি এবং অভিজাত অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রত্যখ সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়েছিল । এটাই ছিলে গৃহযুদ্ধের মূল প্রকৃতি । বলা যায় যে সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডের গৃহ যুদ্ধের প্রকৃতি বা চরিত্র কী ছিল অর্থাৎ এটি ভাবাদর্শসত সংঘর্ষ 'না শ্রেণি সংগ্রাম সে বিষয় কোনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি আছ অবদি সম্ভব হয়নি ।
যেসমস্ত ঐতিহাসিক মনে করেন ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ ছিল ভাবাদর্শগত সংঘর্ষ তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন (S.R Gardiner) এস. আর গার্ডিনার । উনবিংশ শতকের এই ইংরেজ ঐতিহাসিক গৃহযুদ্ধের ওপর একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন "History of the great civil war', তিনি এই যুদ্ধের প্রকৃতি আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন যে এটি ছিল মূলত একটি ভাবাদর্শগত সংঘাত । ধর্মীয় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ক্যাথলিকরা স্টুয়ার্ট রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম করেছিলে । আর এই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে অগিয়ে এসেছিল পিউরিটানরা । তারা স্বৈরাচারী শাসক প্রথম চার্লসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল । পার্লামেন্টের স্বাধীনতা রক্ষা এবং দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ স্থাপন ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য । এই কারণে গার্ডিনার মনে করেন যে সপ্তদশ শতকের বিপ্লব ছিল একটি পিউরিটান বিপ্লব ।
অপর একজন ইংরেজ ঐতিহাসিক (G.M.
Trevelyante) জি.এম ট্রাভেলিয়ন গার্ডিনারের মতোই একই বক্তব্য পেশ করেছিলেন । তিনি বলেন এই বিপ্লব ছিলে, প্রধানত ভাবনার সংগ্রাম আর তিনি ইংরেজ বিপ্লবের সঙ্গে ফরাসি বিপ্লব এবং আমেরিকার গৃহযুদ্ধের তুলনা করেছেন । তার মতে ফরাসি বিপ্লব ছিল মূলত দুটি সামাজিক শ্রেণীর সংঘর্ষ, এরা ছিল অভিজাত ও তৃতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত বুর্জোয়া ও কৃষক শ্রেণী । অন্যদিকে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ ছিল উত্তর দক্ষিনের মধ্যে সংঘাত । কিন্তু সপ্তদশ শতকের ইংল্যান্ডের বিপ্লবের মধ্যে কোনো রূপ কোনো সংঘাত বাধ্য করা যায়না । ইংল্যান্ডে জনগণের অধিকাংশই এই যুদ্ধে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেছিল । আর যুদ্ধে যারা অংশগ্রহন করেছিল তারা ছিল বিভিন্ন শ্রেনিভুক্ত মানুষ । জেন্ট্রি ও কৃষক সম্প্রদায় একদিকে যেমন পার্লামেন্টের বাহিনীতে অংশগ্রহন করেছিল অন্যদিকে তেমনি রাজকীয় শিবিরে তাদের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় ।
সাম্প্রতিককালে ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মধ্যে (Roger Lockyer) রজার লকিয়ার তিনিও গার্ডিনার ও ট্রাভেলিয়নাদের বক্তব্যটি সমর্থন করেছেন । তিনি মনে করেন এই বিপ্লব ছিলে একটি ধর্মীয় বিরোধীর
ফলশুতি । যুদ্ধের সূচনায় যারা রাজার সৈন্যদলে
যোগদান করেছিল তাদের অধিকাংশ চার্চের সদস্য ।
আর পার্লামেন্টের বাহিনী গঠিত হয়েছিল ক্ষমত
নিকট পিউরিটানদের নিয়ে । অর্থাৎ তিনি এই যুদ্ধের
জন্য শুধুমাত্র দলগত সংঘাতকে দায়ি করেননি
ধর্মীয় সংঘর্ষের বিষয়টির ওপর তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব
আরোপ করেছেন । এছাড়া এই বিপ্লবের ক্ষেত্রে শ্রেণী
সংঙ্গামের বিষয়টি তিনি পুরোপুরি মানতে পারেননি।
মার্কসীয় ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে গৃহযুদ্ধ ছিল সামন্ততান্তিক অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল পুঁজিবাদী জেন্ট্রি শ্রেণীর বিদ্রোহ । এরা মনে করেন অভিজাত শ্রেণীকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যেই জেন্ট্রিরাও সংঘর্ষে অবর্তীর্ণ হয়েছে । আর
এই মতবাদের অন্যতম ব্যাখ্যা হলেন মার্কসবাদী
ঐতিহাসিক টনি । তিনি তার "The Rise of The
Gentry" এই প্রবন্ধে গৃহযুদ্ধের প্রকৃতি বিষয়ক যে
সিদ্ধান্তে এসেছিলেন তাতে শ্রেণি সংঘাতের
বিষয়টি ফুটে উঠেছে । আর এই বিপ্লবে জেন্ট্রি শ্রেণীর
কী ভূমিকা ছিল তিনি তার অনেক বিস্তারিতভাবে
আলোচনা করেছেন । তিনি বলেছেন এলিজাবেথের
রাজত্বকালে জেন্ট্রি নামক নতুন জোতদার শ্রেণীর
উদ্ভব ঘটে । পরবর্তীকালে এদের প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি
পেতে থাকে । আর এদের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির
ফলেই তারা রাজনীতিতে ও পার্লামেন্টে একটি প্রধান
গোষ্ঠীরূপে আর্বিভূত হয়েছিল । রাজশক্তির সঙ্গে পার্লামেন্টের যে গৃহযুদ্ধ হয়েছিল সেই পার্লোমেন্ট ছিল প্রধানত জেন্ট্রি প্রভাবিত ।
অধ্যাপক (Trevar-Roper) ট্রেভর রোপার- তিনি এ বিষয় একটু আলাদা ব্যাখ্যা দিয়েছেন । তিনি বলেন যে এই গৃহযুদ্ধ ছিল মূলত ক্ষয়ুষ্ন জেন্টি তার বার্তা বর্ধিষ্নু জেন্টির মধ্যে সংঘাত, শক্ষয়ি্নু জেন্টি ছিল যারা ব্যাবস্যার বানিজ্যে সফেল্য অর্জন করতে পারেননি । অন্যদিকে বর্ধিষ্ণু, জেন্ট্রি ছিল রাজসভার একটি অন্যতম প্রধান শক্তি । যারা ব্যাবসা বানিজ্য থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হয়েছিল । (Oliver Gromwell) অলিভার ক্রমওয়েল ছিলেন দুর্বল ও পশ্চাদপদ জেন্টি সম্প্রদায়ের অন্যতম নেতা এবং শেষ পর্যন্ত তার নেতৃত্বেই গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। অর্থাৎ ট্রেভর রোপারের বক্তব্য ছিল অভিনবত্ব কিন্তু তার সত্ত্বেও এটি পুরোপুরি তত্ত্বভিত্তিক নয়। মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের মধ্যে অন্যতম ক্লিস্টোফার হিলে তার 'The English Revolution' গ্রন্থে বলেন যে, ফরাসি বিপ্লবের মতো ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ ছিল একটি শ্রেণীযুদ্ধ । এই যুদ্ধে জেন্টি শ্রেণী অভিজাত দের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে অবর্তীর্ণ হয়েছিল । এই শ্রেণী সংঘাতের পিছনে ছিল ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের ইল্যান্ডে ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মরিস ডব ও হিল কে সমর্থন করেছেন ।
মার্কস বাদী ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিভত্তিীতে এই বিপ্লব ছিল একটি বুর্জোয়া বিপ্লব ৷ আর এই বিপ্লবে নিম্ন বর্গের মানুষের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । বিপ্লবের যুগে যে সমবত র্যাডিক্যাল গোষ্ঠীগুলি মাথা চারা দিয়ে উঠেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল leveler digger) লেভেলার, ডিগার । তারা শুধু অভিজাত ও রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উচ্ছেদ চায়নি, এরা পার্লামেন্টের আধিপত্য ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ সাধনের মতামত দিয়েছিল । তবে উপযুক্ত জনসমর্থন একশ সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্য এই র্যাডিকাল আন্দোলনগুলি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল ।
সুতরাং গৃহযুদ্ধের উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে আলোচ্য বিষয় ঐতিহাসিক গণ মোটামুটিভাবে দুটি মতে বিশ্বাসী, একদল মনে করেন এই বিপ্লব ছিল মূলত তাবাদর্শগত সংঘাত অন্যদিকে মার্কসবাদী ঐতিহাসিক গন মনে করেন এই যুদ্ধ ছিল মূলত একটি শ্রেণী সংগ্রাম । এ বিষয় এখনো কোনো সর্বজন স্বীকৃত সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি । উভয় গোষ্ঠীর বক্তব্যে কিছু গ্রহনযোগ্য ও বর্জনযোগ্য বক্তব্য আছে। যাইহোক এ বিষয়ও হয়তো আগামী দিনে আরও ব্যাপার গবেষণার ফলে কিছু নতুন আলোকপাত করা সম্ভব হতে পারে ।