ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা লেখ বা, ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিকদের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা কর বা ফরাসি বিপ্লবের পেছনে দার্শনিকদের অবদান সম্পর্কে আলোচনা কর
যখন মানুষের মধ্যে ভাব জগতের পরিবর্তন দেখা দেয় তখনই কোন বিপ্লব সংঘটিত হয় ৷ আবার এই ভাব জগতের পরিবর্তন আনয়নে বুদ্ধিজীবী শ্রেণী বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকেন ৷ ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনার কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি ৷ এই সময় মন্তেস্কু ভলতেয়ার,রুশো, দিদেরো, দা এলেম্বার্ট, কুইসনে, লামেত্রী, মাবলি, কদরসে দার্শনিক গন সমকালীন ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, সামাজিক , অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় অসাম্য ও দুর্নীতির তীব্র সমালোচনা করে সেগুলি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেছিলেন ৷ এর পাশাপাশি এরা জনগণকে উজ্জীবিত করতে নিজেদের অধিকার রক্ষার দাবিতে সোচ্চার হতে ৷ মূলত দার্শনিকদের প্রচেষ্টাতে ফরাসিরা বিপ্লব মুখী হয়ে উঠেছিল ৷
প্রখ্যাত দার্শনিক মন্তেস্কু "দা স্পিরিট অফ লজ" গ্রন্থে রাজার ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতার তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের আইন শাসন ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের দাবি জানিয়েছেন ৷ এছাড়াও মন্তেস্কু "দা পার্সিয়ান লেটারস্" নামক আরও একটি গ্রন্থ রচনা করেন যাতে তিনি ফ্রান্সের দুর্নীতি মূলক সমাজব্যবস্থা ও রাজতন্ত্রের প্রতি তীব্র সমালোচনা করেন । তার বিপ্লবী ভাব দ্বারা ফরাসি বাসীর মনোজগতে বিপ্লবী মানসিকতা তৈরি করেন ৷
দার্শনিক ভলতেয়ার ছিলেন তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ রচনার পারদর্শী একজন প্রগতিশীল যুক্তিবাদী ৷ তিনি লেখনীর মাধ্যমে ফরাসি যাজক ও অভিজাত শ্রেণীর বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তিকে উৎখাতের ডাক দিয়েছিলেন । ভলতেআর আরো বললেন কারো কর্তৃক কখনো অন্ধের মত স্বীকার করা উচিত নয় । তিনি "কাদিদ" ও "লতর ফিলসফিক" প্রভৃতি গ্রন্থে বলেছেন রাষ্ট্রীয় সামাজিক এবং ধর্মীয় অসাম্যকে দূর করতে হবে । ক্যাথলিক গির্জার যাবতীয় ক্ষমতাকে নষ্ট করে দিতে হবে । ভলতেয়ারের এই সকল মন্তব্য গুলি বিপ্লবীদের প্রেরণা জাগিয়েছিল ৷
রুশোকে ফরাসি বিপ্লবের জনক বলা হয় ৷ তার "অসাম্যের সূত্রপাত" গ্রন্থে সাম্যের আদর্শ প্রচার করেছেন ৷ তিনি বলেছেন সকল মানুষ সমান অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন কিন্তু লোভী ও স্বার্থপর সমাজব্যবস্থা তাকে প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে । মানুষের কর্তব্য হলো এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে জন্মগত অধিকার গুলি অর্জন করা ৷ পরবর্তীকালে রুশ তার "সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট" গ্রন্থে রাজার ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতার সমালোচনা করেছেন তিনি বলেছেন জনগণি রাষ্ট্র শক্তির মূল উৎস । কোন এক সময় জনসাধারণের ইচ্ছা অনুযায়ী রাজা সিংহাসনে বসেন তাই রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার জনগণেরই রয়েছে ৷
প্রখ্যাত দার্শনিক দিদেরো ও দা অ্যালেন বার্ড সমসাময়িক বিভিন্ন দার্শনিকদের সহযোগিতায় ১৭ খন্ডের এক বিশ্বকোষ রচনা করেছিলেন ৷ এতে দার্শনিক ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের রচনা স্থান পেয়েছিল ৷ এ রচনা গুলিতে সমসাময়িক ফ্রান্সের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ত্রুটি বিচ্যুতি গুলি জনগণের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল ৷ ফলে এই জনগণ সমসাময়িক ফ্রান্সের পরিণতি সম্পর্কে অবগত হয়েছিল ৷
ফিজিওক্রাস্ট গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা হলেন কেনে ৷ কেনে মনে করতেন সম্পদের একমাত্র উৎস হলো ভূমি,তাই ভূমি থেকেই সব কর আদায় করা উচিত ৷ দেশের অভ্যন্তরে নিয়ন্ত্রিত ও বাণিজ্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক তাই দেশের ভিতর সব শুল্ক বেড়া ভেঙে দেয়া উচিত ৷ অর্থাৎ ফিজিওক্রাস্টগণ বাণিজ্য শিল্পের ব্যাপারে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বড় বিরোধী ছিলেন এরা অবাধ বাণিজ্য ও সার্বজনীন শিক্ষার প্রবল সমর্থক ছিলেন।
ফ্রান্সে বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে উপরিউক্ত দার্শনিকদের অতি নগণ্য অবদান ছিল বলে কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন ৷ অবশ্য ঐতিহাসিক রাইকার,সেতোব্রিয়ে,টেইন,রুস্তান প্রমূখ ফরাসি বিপ্লবের জন্য দার্শনিকদের ভূমিকা কে স্বীকার করেছেন ৷ ট্রেইন বলেছেন যে ফ্রান্স দর্শনের বিষ পান করেছিল ৷ ফরাসি বিপ্লবের পিছনে দার্শনিকদের ঠিক কতটা অবদান ছিল তা নিয়ে বিতর্কে শেষ নেই এ ব্যাপারে সমালোচকরা স্পষ্টই দুই ভাগে বিভক্ত ৷ একদল বিপ্লবের পিছনে দার্শনিকদের ভূমিকা কে স্বীকার করে নিয়েছেন আর অন্য দল দেখাতে চান বিপ্লবের পিছনে দার্শনিকদের ভূমিকা আগেও ছিল না বা থাকলেও নামমাত্র ৷