বর্ণ ও জাতির মধ্যে পার্থক্য কী?
ভারতীয় সমাজব্যবস্থার একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বর্ণ ও জাদি বা বর্ণজাতি প্রথা। এর প্রথম সুনির্দিষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় বৈদিক সাহিত্যে। পরবর্তীকারে হয়েছে। কৌটিল্য, মনু, যাজ্ঞবন্ধ্য প্রমুখ শাস্ত্রকাররা এ ব্যাপারে তাঁদের ধারণা লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁদের প্রণীত গ্রন্থে। ঋগ্বেদে 'বর্ণ' কথাটি একাধিকবার পাওয়া যায়। তবে সেট 'গাত্রবর্ণ' বা 'রং' বোঝাত। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র-চতুর্বর্ণ ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠতে সময় লেগেছিল বেশ কিছুকাল সেটি পরবর্তী বৈদিক যুগে দেখা যায়।
'বর্ণ' ও 'জাতি' কী এবং কীভাবে এর উদ্ভব হয়েছিল। তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধে মতপার্থক্য দেখা যায়। ঐতিহাসিক এ. এল. ব্যাসামের মতে, ইংরেজিতে 'Caste' শব্দটি যে বাংলায় বর্ণ ও জাতি উভয়ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে-তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। তাঁর মতে, চারটি বর্ণ (class) থেকে জাতির উদ্ভব ঘটেনি, জাতি (caste) গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের সূত্র ধরে। তবে তিনি এটিও বলেছেন যে, প্রথম উদ্ভব ঘটেছিল বর্ণের পরে জাতির।
জাতিপ্রথা ও বর্ণভেদ এই দুই বিষয় বাস্তবে পৃথক ও স্বতন্ত্র-এমন মন্তব্য করেছেন-নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর 'প্রাচীন ভারতীয় সমাজ' গ্রন্থে। তাঁর মতে, একটি বিশেষ আদর্শগত দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাচীন যুগের শাস্ত্রকাররা ভারতীয় সমাজকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র-এই চতুর্বর্ণে বিভক্ত করার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। এটা নিছকই আদর্শমূলক; কোনো যুগেই যার বাস্তব অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু যার অস্তিত্ব আছে, তা হল অসংখ্য জাতি। তিনি আরো লিখেছেন যে, জাতি বলতে বোঝায় একটি বিশেষ পেশার ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠীকে, যারা নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেই অন্তর্বিবাহ করে। যারা কণ কেত্রে তাদের নিজস্ব সামাজিক আইনের দ্বারা পরিচালিত এবং যারা পেশাগত বর্তী বিশেষ ধরনের সার্বভৌমত্ব ভোগ করে। একই ধরনের মত দিয়েছেন নীহাররঞ্জন বাঙালির ইতিহাস: আদিপর্ব" গ্রন্থে। তাঁর মতে, প্রাচীন ধর্মসূত্র ও স্মৃতিগ্রস্থের হায়ণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র-এই চতর্বর্ণ কাঠামোর মধ্যে সমগ্র সমাজজীবনকে এটা করেছিলেন, যদিও ওই চতর্বর্ণ প্রথা অলীক উপন্যাস ছাড়া আর কিছুই নয়।
এপাদকে বর্ণ ও জাতি মূলত একই প্রকার-এমন মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক রামশরণ এ Perspective in Social and Economic History of early India' গ্রন্থের সারে তিনি লিখেছেন, বর্ণ ও জাতি উভয়ই বংশানুক্রমিকভাবে নির্ধারিত হত এবং আহার বা ভোজনসংক্রান্ত বিভিন্ন বিধিবিধান উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হত। সুখতা ও বংশানুক্রম বর্ণ ও জাতি উভয়েরই ভিত্তি বলে গণ্য হত। গোড়ার দিকে এক এক বড়ো একক হিসেবে মনে করা হত এবং এক বর্ণের মধ্যে অনেক জাতি হতে এই তাই দেখা যায় যে, মূল বর্ণ চারটি হলেও জাতির সংখ্যা কার্যত অনেক। জাতি হিত জন্মের দ্বারা, যা বর্ণ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হত বলে তাঁর মনে
সুতরাং বলা যায় যে, বর্ণ ও জাতি ব্যবস্থা দুটি পৃথক বা একই প্রথা-যাই বলা হোক এস. এগুলি ছিল সামাজিক ভেদাভেদ বজায় রাখার বিশেষ পদ্ধতি। বস্তুত, চারটি বর্গ এবং সেগুলির অধীনে যে অসংখ্য জাতি আছে সেগুলি নিজ নিজ নিয়ম বা জানা রজ্জুতে বাধা। এগুলি নিজস্ব সামাজিক ও ধর্মীয় আচারের পদমর্যাদা অনুসারে সাজানো ৷