তাম্রপ্রস্তর যুগ বলতে কী বোঝ?
প্রস্তর যুগের তৃতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ, নব্য প্রস্তরযুগে ভারতীয় আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়। স্থায়ী কৃষিভিত্তিক জীবিকা গড়ে ওঠে। পাথরের ব্যবহারের পাশাপাশি ধাতুর ব্যবহার এই সময়ে শুরু হয়। এই পর্যায়ে তামার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য ভাবে দেখা দেয়। তাই ঐতিহাসিক রেমন্ড অলচিন ও ব্রিজেৎ অলচিন আলোচ্য সময়কে তাম্রপ্রস্তর যুগ অভিধায় চিহ্নিত করেছেন। পাথরের হাতিয়ার ও সামগ্রী নির্মিত হলেও ধাতবসামগ্রীর উপস্থিতি ক্রমবর্ধমান। উপমহাদেশের প্রথম নগরাশ্রয়ী সমাজ ও সংস্কৃতির যে পরিচয় হরপ্পা সভ্যতাতে বিবৃত আছে, তা তাম্র প্রস্তরযুগের সভ্যতা।
নব্যপ্রস্তর তথা তাম্রপ্রস্তর পর্বের সংস্কৃতি উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। তবে সেগুলি একই ধারায় গড়ে ওঠেনি। আঞ্চলিক বৈচিত্র্য এই সংস্কৃতিকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে প্রথম নগরাশ্রয়ী হরপ্পা সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল। এছাড়া মেহেরগড়, কোটদিজি, কিলিগুল মহম্মদ প্রভৃতি এলাকায় তাম্রপ্রস্তর সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হয়। এগুলিই পরবর্তীকালে বিকশিত হয়ে নগরকেন্দ্রিক হরপ্পা সভ্যতার উন্মেষ ঘটিয়েছিল। হরপ্পা পরবর্তী পর্যায়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তাম্র প্রস্তর যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন থেকে। রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, গাঙ্গেয় উপত্যকায় তামা ব্যবহারের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। রাজস্থানের বালাথল,
বানস সংস্কৃতি; মহারাষ্ট্রের মালওয়া সংস্কৃতি, মধ্যপ্রদেশের কায়থা সংস্কৃতি-এগুলি সবই তাম্রপ্রস্তর সংস্কৃতির অন্তর্গত। পূর্ব ভারতে পশ্চিমবঙ্গের পান্ডুরাজার ঢিবি, বিহারের চিরান্দ, অসমের দেওজালি হাদিং প্রভৃতি স্থানেও তাম্রপ্রস্তর যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে। দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারতে বিশেষ করে কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের একাধিক প্রত্নক্ষেত্র তাম্রপ্রস্তর যুগের নিদর্শন বহন করছে। যেমন-উৎনূর, ব্রহ্মগিরি, কোজগাল, পিকলিহাল, হাল্লর, মাস্কি প্রভৃতি। এগুলি পশুপালকদের দ্বারা নির্মিত বসতি।
অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরে উপমহাদেশের যে চিত্র আমরা দেখলাম, তার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের পূর্বে ভারতের সর্বত্র যে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটে চলেছিল, তার আঞ্চলিক তারতম্য দেখা যায়। মানব সভ্যতার বিবর্তনে এই ছোটো অথচ গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। ধাতুর ব্যবহার অবশ্যই সমাজে প্রভাব ফেলেছিল, যার ফলে জটিল নগরাশ্রয়ী সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। তাই বলা যায় যে, তাম্র প্রস্তরযুগ ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক সৃজনশীল পর্ব।