তৃতীয় বিশ্ব বলতে কী বোঝো? আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের প্রভাব আলোচনা কর

তৃতীয় বিশ্ব বলতে কী বোঝো? আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব আলোচনা কর বা,তৃতীয় বিশ্ব বলতে কি বোঝো? তৃতীয় বিশ্বের উত্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতির উপর কি প্রভাব ফেলেছিল

তৃতীয় বিশ্ব বলতে কী বোঝো? আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের প্রভাব আলোচনা কর

১৯৪৩ থেকে ৭০ খ্রিস্টাব্দ এই সময়কালের মধ্যে এশিয়া আফ্রিকায় ৬৪টির বেশি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে ৷ ভারতবর্ষে ক্ষমতার হস্তান্তর মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই ঘটবে ঘটেছিল । যদিও ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভারতবর্ষের রাজনীতিকে কলুষিত করেছিল ৷ অপরদিকে আবার কতগুলি রাষ্ট্র যেমন আলজেরিয়া, ভিয়েতনাম, মুজাম্বিক প্রভৃতি উপনিবেশ গুলি দীর্ঘকাল ব্যাপী তীব্র সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা অর্জন করে ৷ এক্ষেত্রে আরেকটি ব্যাপার বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়তা হল যুগশ্লাভাকিয়া একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ ছিল ভিয়েতনাম, বালুচিয়া প্রকৃতি দেশগুলি সমাজতান্ত্রিক গোষ্ঠীভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তাদের নিজেদের স্বতন্ত্র রক্ষাকল্পে তৃতীয় বিশ্বে এদের উপস্থিতি একটা অন্য মাত্রা ধারণ করে ৷

তৃতীয় বিশ্ব বলতে কোন নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চল কে বোঝায় না, কারণ যেসব দেশকে তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত করা হয় তারা ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া , আফ্রিকা বিভিন্ন অংশ ছড়িয়ে আছে ৷ কোন বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে তৃতীয় বিশ্বকে নিহিত করা যায় না ৷ প্রকৃতপক্ষে কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তৃতীয় বিশ্ব রাষ্ট্রগুলিকে চিহ্নিত করা যেতে পারে এই বৈশিষ্ট্য গুলি হল প্রথমতঃ এই সমস্ত দেশ উপনিবেশিক অথবা আধা উপনিবেশিক শাসনের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যুক্ত ছিল দ্বিতীয়ত সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে তারা অনুন্নত ছিল তৃতীয়ত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তারা উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের দাবেদার ছিল চতুর্থতঃ এইসব দেশে উপনিবেশিক শোষণের জর্জরিত ছিল পঞ্চমত বৈজ্ঞানিক কারিগরি প্রযুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে এরা উন্নত দেশগুলির উপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীল ছিল ৷


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমজাতীয় বৈশিষ্ট্য থাকলেও এর সুসঙ্ঘবদ্ধ অখন্ড একটি গোষ্ঠী হিসাবে গণ্য করা যায় না ৷ কারণ এদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে ব্যবধান ছিল বিস্তর ৷ কোন কোন রাষ্ট্র দরিদ্রতা ছিল আবার কিছু রাষ্ট্র অপেক্ষা কৃত অবস্থাপন্ন ছিল ৷ এছাড়া ও সরকারি ব্যবস্থা রাজনৈতিক মতাদর্শ অর্থনৈতিক কাঠামো ইত্যাদি দিক থেকে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যথেষ্ট বৈচিত্র্য বিদ্যমান ৷ তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির সর্ব ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির অধীনস্থ হয়ে পড়েন এই বিষয়টি কোর ফিলিপিয়া বা সেন্ট্রাল পেরিফিলি রিলেশন নামে অভিহিত হয়ে থাকে ৷ সাধারণত দেখা যায় পূর্বতন উপনিবেশ গুলি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রত্যক্ষ দেশগুলির পর্যায়ে ভুক্ত ছিল এবং পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলি কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল ৷

সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির হাত থেকে মুক্ত হবার পর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে তীব্র অর্থ সংকটে পড়তে হয় ৷ কারণ উপনিবেশ দেশগুলির অবসান ঘটায় প্রত্যক্ষ দেশগুলি থেকে বিপুল সংখ্যক মূলধন কেন্দ্রীয় দেশগুলিতে স্থানান্তরিত করা হলো তৃতীয় বিশ্ব ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে । এই অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলি তাদের অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পুনর্গঠন এর উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তীব্র অর্থ সংকট জনিত কারণে তাদের পরিস্থিতি অতি সংকট ও অসহায় করে তোলে ৷ আর এই সংকট মোকাবিলায় কল্পে তৃতীয় বিশ্ব দেশ গুলির বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থান যেমন আইএমএফ, ডব্লিউ.বি, ডব্লিউ.টি.ও নিকট হতে প্রচুর অর্থ শর্তসাপেক্ষ ঋণ হিসেবে গ্রহণ করতে হয় । ল্যাটিন আমেরিকার ব্রাজিল তাদের ভেঙে পড়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পুনর্জীবিত করার উদ্দেশ্যে প্রচুর বিদেশী মূলধনের লোকদের সুযোগ দেয় ৷ কিন্তু লগ্নিকারীরা শ্রমিক সংস্থার একাধিক কঠোর শর্ত চাপিয়ে দেয় । মূলধন বিনিয়োগের পূর্বে তার ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও শ্রমিক শ্রেনির কোন উন্নতি ঘটেনি ৷

তৃতীয় বিশ্ব দেশ গুলিতে প্রথম দিকে নির্দেশ কতকগুলি উন্নয়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হয়। এগুলি হলো সাধারণত রপ্তানিজাত শিল্প ব্যবস্থা ৷ এই রপ্তানি শিল্প বিনিয়োগ করা হয় ৷ ডব্লিউ ডব্লিউ রস্তন মনে করেন যে," এই ধরনের মূলধন বিনিয়োগ স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়নের সহায়ক হয়ে পড়ে কারন, এর ফলে সাধারণ উন্নয়নের পথ প্রস্তুত হয় যা শেষ পর্যন্ত উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠা করে ৷"


১৯৬০ এর দশকে ভারতের ন্যায় দেশে গ্রিন রেভেল্যুশন বা সবুজ বিপ্লব যথেষ্ট সাড়া জাগায় ৷ সবুজ বিপ্লব বলতে বিশেষ এক ধরনের কৃষি উৎপাদন কৌশল কে বোঝায় ৷ সবুজ বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের প্রয়োগ দ্বারা কৃষিজ ও পণ্যের উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি করা । এ কথা সত্য যে এই ব্যবস্থার ফলে স্বল্পকালীন ভিত্তিতে কৃষিজ উৎপাদন দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায় ৷ কৃষিজ পন্যের উৎপাদন এই ব্যবস্থার পর কোন কোন ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল ৷ অবশ্য দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে দেখা যায় সবুজ বিপ্লব ভারতীয় কৃষক সমাজে উল্লেখযোগ্য কোনো নবায়ন আনতে পারেনি ৷ আবার এক ব্যবস্থার জন্য কোন উন্নত প্রযুক্তির আমদানির ক্ষেত্রে সব তৃতীয় বিশ্বের অনেক বেশি উন্নত দুনিয়ার মুখোপক্ষী কি হয় ৷


১৯৩৪ সালে ইউএসএ কংগ্রেস একটি আইন পাস করেন যে আইন অনুযায়ী স্থির হয় যে মার্কিন সরকার বিদেশে খাদ্য রপ্তানির ব্যাপারটি যখন তখন বন্ধ করে দিতে পারেন ৷ এই ধরনের কার্যকলাপের ফলে বালুচিয়া, ইথিওপিয়া,ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশগুলি একটি দুর্ভিক্ষজনিত সংকটের সম্মুখীন হয় । এর কারণ হলো এই যে এই দেশ গুলির রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল কাজেই দেখা যায় যে তথাকথিত গ্রিন রিভলিউশনের ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দেশ গুলি বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় বিশ্বের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সমর্থ হয়েছিলেন ৷ এছাড়াও usa green revolution কে বিশেষ অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে ৷ যাতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে মার্কসবাদের প্রসার রোধ করা সম্ভব হয় ৷


ভারতবর্ষের পাঞ্জাবে সবুজ বিপ্লবের তরুণ কৃষি উৎপাদনের দিকটিই যথেষ্ট অগ্রসর হয়েছিলেন ৷ পাঞ্জাবের সবুজ বিপ্লবের তরুণ সম্পদশালী কৃষকরা উপকৃত হয় । এক ধরনের বিশেষ ধনী কৃষকের আবির্ভাব চোখে পড়ে। যাদের কুলার বলে অভিহিত করা হয় ৷ এই শ্রেণীর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সম্পদশালী হয়ে উঠলেও রাজনৈতিক ক্ষমতা পুরানো সামন্ত শ্রেণির হাতেই থেকে যায় ৷ ১৯৮০ এর মাঝামাঝি এই কুলাত বা সম্পদশালী চাষীরা রাজনৈতিক ক্ষমতা দাবী করলে খালিস্থান আন্দোলন শুরু হয় ৷

উন্নত ধরনের প্রযুক্তির জন্য তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলি প্রথম বিশ্বের ওপর পুরো মাত্রায় নির্ভরশীল হওয়ায় সমস্যার সৃষ্টি করে ৷ লরেখ সুরেন্দ্র বলেছেন অনেক ক্ষেত্রে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সবুজ বিপ্লবের বিষয়টি ঘটেছিল ফলস্বরূপ পরিবেশের ওপর নানা প্রকার সমস্যা তৈরি হয় ।

তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির নানাবিদ সমস্যা সত্বেও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ৷ 1955 সালের এপ্রিলে বান্দুং সম্মেলন এসি ও রাষ্ট্রগুলির প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এ থেকে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির আত্মপরিচয়ের পদ প্রস্তুত হয় ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিভাজন যে জটিলতা সৃষ্টি করে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির জোটবদ্ধতা আর সেই সমস্যার আংশিক সমাধানের সক্ষম হয় । কেননা নির্জোট আন্দোলন কার্যত দুই সুপার পাওয়ার এর মধ্যে সংঘাতের তীব্রতা কে কিছুটা হাস করতে সক্ষম হয়েছিল ৷ ১৯৭৩ সালের নির্জোট রাষ্ট্রগুলি একটি নতুন গোষ্ঠী গড়ে তোলেন যা G-77 নামে অভিহিত করা হয় ৷ 1988 সালে এই গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়ায় ১২০ ৷


প্রথম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলি বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র GATT ও DANCLE প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের উপর তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন | GATT চুক্তির মূলত ১৯৪৭ সালের স্বাক্ষরিত হয় ৷ মূলত এক অঞ্চল থেকে অন্যত্র পণ্য সামগ্রী ও পুজি সরবরাহের জন্য এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভীষণভাবে উপকৃত হয় ৷ কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি ও পণ্য সামগ্রী বহির্বিশ্বের সরবরাহের পথ প্রস্তুত হয় ৷ এই সময়ে পেটেন্ট কপি রাইট গ্রেট মার্ক, পেটেল আইন ইত্যাদি চালু করা হয় যার তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে ক্ষতিকারক ছিল ৷ কারণ এর ফলে নীল হলুদ বাসমতি রকমের চাল ইত্যাদি সত্ত্ব তৃতীয় বিশ্বের হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হয় ৷


অতএব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার বিশ্ব রাজনীতিতে সর্বাপেক্ষা আলোচিত বিষয় হলো মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রথম বিশ্ব এবং সোভিয়েত রাশিয়া নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবস্থানের মাঝামাঝি জহরলাল নেহেরু সুকর্ণ,নাসের, মার্শাল প্রমুখর নেতৃত্ব হাত ধরে তৃতীয় বিশ্বের আবির্ভাব এবং এর আবির্ভাব বিশ্ব রাজনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে ৷ যদিও আর্থিক ও প্রযুক্তিগত প্রয়োজনীয়তা তৃতীয় বিশ্বকে অনেক উন্নত দেশগুলির মুখোপরিপ করে তুলেছিলেন ৷ তত সত্ত্বেও তৃতীয় বিশ্ব অর্থাৎ এশিয়া আফ্রিকা ও লাতিনা আমেরিকার পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্রগুলি নিজস্ব সব ক্রিয়তা রক্ষার্থে একটা শক্তিশালী স্বতন্ত্র রাজনৈতিক মন্ত্রের জন্ম দেয় ৷




About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟