উপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের অবশিল্পায়নের বিভিন্ন কারণগুলি আলোচনা কর

উপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের অবশিল্পায়নের বিভিন্ন কারণগুলি আলোচনা কর

 উপনিবেশিক শাসনকালে ভারতের অবশিল্পায়নের বিভিন্ন কারণগুলি আলোচনা কর 

এককথায় অবশিল্পায়ন বলতে বোঝায় শিল্পায়নের বিপরীত, শিল্পের অধোগতি। অর্থাৎ শিল্প গড়ে ওঠার বদলে শিল্পের ধ্বংস। সাধারণভাবে উনিশ শতকে ভারতীয় কারিগরী ও কুটির শিল্পের বিপর্যয়কে ঐতিহাসিকরা অবশিল্পায়ন বলেছেন। এটির দিকেও জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ যেমন, মহাদেব গোবিন্দ র‍্যানাডে, রমেশচন্দ্র দত্ত, দাদাভাই নওরোজী প্রমুখ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তাঁদের মতে হস্তশিল্পের বিপর্যয় ভারতীয় শিল্পকে ধ্বংস করেছিল। ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা করে তা দেখিয়েছেন। রজনীপাম দত্ত, ধনঞ্জয় রামচন্দ্র গ্যাডগিল, সারদা রাজু, নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ, অমিয়কুমার বাগচী প্রমুখ আধুনিক লেখক এই অবশিল্পায়ন মেনে নিলেও, পণ্ডিতদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। সে প্রসঙ্গ পরে। আপাতত অবশিল্পায়নের সংজ্ঞা নিয়ে আরও আলোচনা করা যেতে পারে।


ডঃ সব্যসাচী ভট্টাচার্য লিখেছেন, "শিল্পায়নের লক্ষণ হল কৃষিকার্য থেকে উৎপন্ন জাতীয় আয়ের অংশের তুলনায় শিল্পকর্ম থেকে উৎপন্ন অংশ অনুপাতে বাড়ে, শিল্পকর্মে নিয়োজিত জনসংখ্যা কৃষিকর্মে নিয়োজিত মানুষের অনুপাতে বৃদ্ধি পায়। এর বিপরীত যদি হয়, অর্থাৎ যদি দেশের মানুষ শিল্পকর্ম ছেড়ে চাষ আবাদে জীবিকা অর্জন শুরু করে, অথবা জাতীয় আয়ে কৃষিজ অংশ বাড়তে থাকে আর শিল্পজ অংশ কমতে থাকে তা অবশিল্পায়ন (de-industrialisation) বলা চলে। সুতরাং অবশিল্পায়ন শুধু শিল্পের ধ্বংস বা শিল্পের অধোগতি নয়, জীবিকা হিসেবে কৃষির তুলনায় শিল্পের নগণ্য ভূমিকা, জাতীয় আয় মূলত কৃষিক্ষেত্র থেকে উৎপন্ন হওয়া।


সুতরাং, উপরোক্ত সংজ্ঞা থেকে পরিষ্কার যে ধননিঃসরণ এবং অবশিল্পায়নের যা চরিত্র, তা ঔপনিবেশিক শাসকদের পক্ষে লাভজনক এবং স্বার্থপন্থী হলেও, ভারতের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়েছিল। দাদাভাই নওরোজী তাঁর Poverty and Un-British Rule in India গ্রন্থে সে-বিষয়ে সুন্দরভাবে আলোচনা করেছেন।


কোম্পানির আমলে দেশীয় কুটির শিল্পের ধ্বংসসাধন এবং করিগরদের সর্বনাশও ঐতিহাসিক সত্য । অবশিল্পায়নও তাই সন্দেহের উর্ধে । এ বিষয়ে কিছু সাম্রাজ্যবাদী ও পশ্চিমী লেখক অযথা বিতর্কের অবতারণা করেছেন । অবশিল্পায়ন কাকে বলে তা আমরা আগেই দেখেছি। কোম্পানির আমলে প্রাচীন কুটির শিল্পের অবনতি, বস্ত্রশিল্পের ধ্বংস এবং ভারতবর্ষকে ইংল্যাণ্ডের কৃষিখামারে (Agricultural Farm of England) পরিণত করার ব্যাপারটি যেহেতু অস্বীকার করা যায় না, তাই অবশিল্পায়নের তত্ত্ব মেনে নিতে হয়। জাতীয়তাবাদী নেতারা, অর্থনীতিবিদ, ঐতিহাসিক অনেকেই তা মেনেছেন। দেশ-বিদেশের পণ্ডিতেরা এ নিয়ে চর্চা করেছেন। যেমন আমেরিকান লেখক মরিস ডেভিড মরিস, জাপানী ইতিহাসবিদ তরু মাৎসুই এবং ভারতীয় পণ্ডিত ডঃ তপন রায়চৌধুরী, ডঃ বিপান চন্দ্র প্রমুখ এই তর্কে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তবে সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে অবশিল্পায়ন অস্বীকার করা হলেও তার ঐতিহাসিকতা স্বীকার্য। তবে বিষয়টি বিতর্কিত।' তবে ধনঞ্জয়,রামচন্দ্র গ্যাডগিল থেকে অমিয়কুমার বাগচী পর্যন্ত অবশিল্পায়ন মানেন।


জাতীয়তাবাদী লেখকবৃন্দ (যেমন রমেশচন্দ্র দত্ত, র‍্যানাড়ে, মালব্য প্রমুখ) সমসাময়িক ইংরেজ আমলাদের প্রতিবেদন, বিদেশীদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত, সরকারি অর্থনৈতিক তদন্ত ইত্যাদির ভিত্তিতে আঠারো শতক থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কুটির শিল্পের ক্রমাবনতি দেখিয়েছেন। উনিশ শতকের শুরু থেকে আমদানি রপ্তানির হিসেব থেকে দেখা যায় যে কুটির শিল্পজাত পণ্যের রপ্তানি একদিকে কমেছে, অপরদিকে ইংল্যাণ্ডের শিল্প দ্রব্যের আমদানি বেড়েছে। ১৮৫৮-র পরেও অবস্থা বদলায় নি যদিও তখন শিল্পায়ন প্রচেষ্টা-ভারতে স্বদেশী ও বিদেশী উদ্যোগে শুরু হয়েছে।


এককালে ভারতীয় সূতির বস্ত্র বিপুলভাবে রপ্তানি হত সর্বত্র অথচ ১৮৬০ এ সুতির কাপড় আমদানি হয়েছে ৯৬ লক্ষ পাউণ্ডের, ১৮৮০-তে তা বেড়ে দাড়িয়েছে ১ কোটি ৭০ লক্ষ পাউণ্ড আর ১৯০০ খ্রিঃ নাগাদ ২৭ কোটি পাউণ্ড। বস্তুত ভারত স্বকীয় শিল্পকর্ম হারিয়ে ইংল্যাণ্ডে শিল্পদ্রব্যের বাজারে পরিণত হলো। অধ্যাপক নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ গবেষণা করে দেখিয়েছেন অবশিল্পায়নের সবচাইতে বড়ো দৃষ্টান্ত বস্ত্রশিল্পের ধ্বংস। মুক্ত বাণিজ্যের হোতা ইংল্যাণ্ডের প্রতিভু ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, তবু তারাই একচেটিয়া শুরু করে এবং রাজনৈতিক জোরখাটিয়ে বস্ত্রশিল্পকে সংকটাপন্ন করে তোলে। মাদ্রাজের ক্ষেত্রে শারদা রাজু, অন্ধ্রপ্রদেশের ক্ষেত্রে রমন রাও, গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আর. ভি. চোকসি এবং বাংলার ক্ষেত্রে হরিরঞ্জন ঘোষাল গবেষণা করে এই অবশিল্পায়নের চিত্র দেখিয়েছেন। মনে রাখা দরকার, ঐ সময় ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব হয় এবং সেই কারণে উপনিবেশ হাতে থাকাতে, কোম্পানি ভারতকে কাচামাল সংগ্রহের দেশ এবং একইসঙ্গে সেই কাঁচা মাল সংগ্রহ করে নিজেদের দেশে এনে, শিল্প পণ্য উৎপাদন করে, আবার উপনিবেশে রপ্তানি করে মুনাফা দেশে নিয়ে আসা শুরু করে। এই ঔপনিবেশিক চক্রের সঙ্গে অবশিল্পায়ন জড়িত ছিল।


অবশিল্পায়নের বিপক্ষে যে সব গবেষক যুক্তি পেশ করেছেন, সেগুলি নানারকম। প্রথমত একদল মনে করেন অবশিল্পায়ন হয়েছিল উনিশ শতকের প্রথমার্ধে, কিন্তু তারপর ভারতে বহু কলকারখানা গড়ে উঠেছে। উনিশ শতকের শেষে বা বিশ শতকের গোড়ায় অবশিল্পায়নের প্রমাণ নেই। এই মতের প্রবক্তাদের অন্যতম ড্যানিয়েল থর্নার'। এই মতের প্রবক্তাদের বক্তব্য এই যে, ১৮৮১ থেকে ১৯৩১ এর মধ্যে ভারতীয় জনগণনার হিসেবে কৃষি ও শিল্পকর্মে নিয়োজিত মানুষের হিসেব থেকে প্রমাণ হয় না যে অবশিল্পায়ন চলছিল। একথা যদিও সত্য যে অবশিল্পায়ন মূলত ঘটেছিল ১৮০০-১৮৬৫ সময়ের মধ্যে, তবু একথাও মানতে হবে "কেবল শিল্প বা কৃষিকর্মে ক'জন জীবিকা অর্জন করছে এই আদমসুমারি অবশিল্পায়ন তর্কের শেষ কথা নয়।" জন প্রতি উৎপাদন বাড়ে-কমে কারিগরী (Technological) পরিবর্তন অনুযায়ী এবং এইভাবে কৃষি বা শিল্পের উৎপাদন বাড়তে বা কমতে পারে, কর্মী সংখ্যার হিসেব যখনই হোক না কেন; এই উৎপাদনের হিসেবটা অর্থাৎ জাতীয় আয়ে শিল্পজ বা কৃষিজ আয়ের অংশ না জানলে পরে অবশিল্পায়ন সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায় না।'


দ্বিতীয়তঃ, একদল মনে করেন অবশিল্পায়ন আদৌ হয়নি। এই মতের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা আমেরিকান ঐতিহাসিক মরিস ডেভিড মরিস', এদের যুক্তি হলো: জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা শিল্পদ্রব্যের আমদানি বৃদ্ধি মানেই অবশিল্পায়ন ভেবে ভুল করেছেন। যদি জনসংখ্যা আর জাতীয় আয় বাড়ে তবে দেশীয় শিল্প অক্ষুন্ন রইলো-আমদানিও বাড়লো। তাছাড়া শিল্পদ্রব্যের আমদানিতে যেমন এক দেশীয় শিল্প ক্ষতি হতে পারে তেমনি অন্য শিল্পের বৃদ্ধি হতে পারে। আরও বলা যায় যে, বিলিতি উৎপন্ন পণ্য আমদানি সত্ত্বেও অনেক প্রাচীন কুটির শিল্প টিকে ছিল নিজস্ব বাজার থাকার জন্য। এই যুক্তিগুলি একটিও তথ্যের দ্বারা সম্পূর্ণ সমর্থিত হয় না বলে সব্যসাচী ভট্টাচার্য মনে করেন। আগেই অবশ্য বিপান চন্দ্র, তপন রায়চৌধুরী প্রমুখ মরিস ডি মরিসের যুক্তির সারবক্তা খণ্ডন করেছিলেন।


তৃতীয়ত, একদল লেখক মনে করেন অবশিল্পায়ন হয়েছিল বটে কিন্তু আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগ (division of labour) কৃষিপ্রধান ভারত ও শিল্প প্রধান ব্রিটেনের মধ্যে হওয়াটা স্বাভাবিক ও উভয়ের পক্ষেই লাভজনক। এই মতের প্রবক্তা রিচার্ড কবডেন, জন ব্রাইট, থিয়োডর মরিসন প্রমুখ। এই দৃষ্টিভঙ্গির সারকথা হলো অর্থনৈতিক অগ্রগমনের রাস্তা শ্রমবিভাজন। তাই ইংল্যাণ্ড শিল্পপ্রধান এবং ভারতীয উপনিবেশ কৃষিপ্রধান হওয়াতে উভয়ের মঙ্গল ও লাভ। বলা বাহুল্য এই মতও গ্রহনীয় নয়। প্রাক্ ঔপনিবেশিক গ্রামের স্বনির্ভরতা, গ্রামীণ অর্থনীতিতে শিল্প ও কৃষির মিলন, ভারতীয় শিল্প পণ্যের বিদেশে চাহিদা, বিশেষত সূতিবস্ত্রের-এগুলি অনস্বীকার্য এবং ব্রিটিশ আমলে তার ধ্বংসও আমরা মানতে বাধ্য। ব্রিটেন শিল্প বিপ্লবের, ভারত থৈকে কাঁচামালের, ভারতের বহির্গত সম্পদের অর্থাৎ মূলধনের এবং ভারতীয় বাজারে বিক্রির সুযোগ সদ্ব্যবহার করেছিল।


কার্ল মার্ক্স তার Captial গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে লিখেছেন যে ভারত থেকে বহির্গত সম্পদ ব্রিটেনে গিয়ে শিল্প পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ভারত থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়া সম্পদ ব্রিটেনের এক শ্রেণীর মানুষকে অর্থশালী করে তোলে এবং তারা সেই সঞ্চিত অর্থ ব্রিটেনে শিল্প-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করে। সুতরাং ভারতের অবশিল্পায়ন, ধননিঃসরণ এবং ব্রিটেনের উন্নতি একসূত্রে বাঁধা। তবে ১৭৫৭-১৮১৩ পর্বে ধননিঃসরণ হলেও তখন ছিল কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য, তবে ১৮১৩-র পর অবাধ বাণিজ্য নীতি গৃহীত হবার পরই অবশিল্পায়ন এবং ধননিঃসরণ দুটোই বৃদ্ধি পায়। ভারত থেকে কাঁচামাল পাঠাও, বিলেত থেকে মিলের কাপড় আনো এই নীতিতে তাঁতিদের সর্বনাশ, কোম্পানির পৌষমাস। মনে রাখতে হবে, ১৮১৩-তে ইংল্যাণ্ডের সরকার বাংলার মসলিনের উপর ৪৪% এবং ক্যালিকো ও 'ডিমিটি' কাপড়ের উপর ৮৫% আমদানি শুল্ক ধার্য করে। ক্রমে ম্যানচেষ্টারের বিলিতি মিলের কাপড় ভারতের বাজার ছেয়ে ফেলল। দামও ভারতের কাপড়ের চেয়ে সস্তা। ব্যস, ভারতীয় বাজার চলে গেল আর বিদেশে রপ্তানি তো আগেই বন্ধ। সুতরাং জাতীয়তাবাদী নেতারা ঠিকই দেখিয়েছিলেন যে, একদিন সেই সোনার সময় ছিল যখন- 'বাংলার মসলিন বাগদাদ, রোম, চীন / কাঞ্চন তৌলেই কিনতেন একদিন', তা ধ্বংস হয়ে গেল। রমেশচন্দ্র দত্ত এই সূতিবস্ত্র শিল্পের অবলুপ্তিকেই চিহ্নিত করেছেন সবচেয়ে দুঃখজনক অধ্যায় বলে।


📛এই নোটটি পড়লে তুমি কোন কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেঃ-

  • অবশিল্পায়নের বলতে কি বুঝ? উপনিবেশিক আমলের ভারতে অবস্থিত ফলাফল গুলি আলোচনা করো 
  • ​অবশিল্পায়ন কি ? ঔপনিবেশিক ভারতে অবশিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল লেখো ।
  • উপনিবেশিক ভারতে অপশিল্পায়নের কারণ ও ফলাফল ব্যাখ্যা কর 
  • ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে শিল্প বাণিজ্যে ধ্বংসের কারণ ও ফলাফল উল্লেখ কর ৷ 
  • অবশিল্পায়ন বলতে কী বোঝো? উপনিবেশিক আমলে ভারতে অবশিল্পায়ন সম্পর্কে আলোচনা কর 
  • অবশিল্পায়ন কি এর কারণ ও ফলাফল লেখো

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟