মধ্য প্রস্তর সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
মধ্যপ্রস্তর সংস্কৃতি এমন এক সংস্কৃতি যেটি ছিল অন্তপুরাতন প্রস্তর সংস্কৃতির পরবর্তী ও নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতির পূর্ববর্তী পর্যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক যুগের এই দ্বিতীয় পর্বটির ইংরেজি ভাষায় মেসোলিথিক বলেই পরিচিত। এই যুগকে 'মাইক্রোলিথিক' বা 'ক্ষুদ্র প্রস্তর যুগ' বলেও অভিহিত করা হয়। কারণ এই পাথরের হাতিয়ারগুলি আকারে অনেক ক্ষুদ্র ছিল। ভারতে এই যুগের সূচনা হয়েছিল হলোসিন যুগের গোড়ার দিকে।
মধ্যপ্রস্তর সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য হল হাতিয়ার তৈরির ক্ষেত্রে স্বতন্ত্রতা বজায় রাখা। এই যুগের হাতিয়ারগুলি পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় আকারে অনেক বেশি ক্ষুদ্র ছিল। এই সময়ে ১ সেমি থেকে ৪ সেমি লম্বা সূক্ষ্ম দানাপাথরের তৈরি হাতিয়ার বেশি ব্যবহার হতে থাকে। এই যুগে বড়ো হাতিয়ারের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ছিল ৮ সেমি। এই পর্বে মূলত চার্ট, কোয়াটর্জ ও ব্যাসল্ট জাতীয় পাথরের পাশাপাশি অ্যাগেট, সিলিকা জাতীয় পাথর ব্যবহৃত হতো। এই যুগের উল্লেখযোগ্য হাতিয়ারগুলি হল বাটালি, চাঁচনি, ব্লেড, তুরপুন, ত্রিকোদী ইত্যাদি।
মধ্যপ্রস্তর যুগে কেবলমাত্র হাতিয়ারের দিক থেকে নয়, মানুষের উন্নয়ন ঘটেছিল সবদিক থেকেই। পরিবর্তন এসেছিল প্রযুক্তিবিদ্যা, বসতি, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা ইত্যাদিতে। এই যুগের মানুষ আগুন ব্যবহারের কায়দা খুব ভালো করে রপ্ত করেছিল। এই যুগের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল সাধারণভাবে এই যুগেও মানুষ গুহাশ্রয়েই বসবাস করতো, তথাপি এই যুগেই প্রথম কুটির নির্মাণের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। এই যুগে মৃৎপাত্র নির্মাণ শুরু হলেও চাকার ব্যবহার তখনও শুরু হয়নি বলে জানা যায়।
মধ্যপ্রস্তর যুগে সর্বদিকে অগ্রগতি হলেও মানুষ তখনও পর্যন্ত খাদ্য সংগ্রাহক ছিল, খাদ্য উৎপাদকের উত্তরণ পর্যায় তখনও ঘটেনি, তবে এই সময় পশুপাখির মাংসের পাশাপাশি শাকসবজি ও শস্য দানা খাদ্য হিসেবে প্রচলিত ছিল। এই যুগে কাঁচা মাংস খাওয়ার অভ্যাস পরিত্যক্ত হয়েছিল এবং শিকার করা মাংস পুড়িয়ে খাওয়া হত। এই পর্যায়ে কৃষিকাজ শুরু হয়নি, তবে পশুকে পোষ মানাতে মানুষ শিখেছিল। কুকুরই ছিল প্রথম গৃহপালিত প্রাণী। এই যুগ থেকে কুকুর ছিল শিকারী মানুষের সঙ্গী ও শিকারে সাহায্যকারী। এই যুগের মানুষ পোশাক হিসেবে গাছের ছাল ও পশুর চামড়াই ব্যবহার করতো। তবে হাড়ের তৈরি সূচের নিদর্শন পাওয়া যায় এইপর্বে। বেশ কিছু হাড়ের তৈরি অলংকার, পাথর ও শামুকের খোলার পুঁতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই যুগের প্রধান জীবিকা ছিল শিকার ও ফলমূল সংগ্রহ।
মধ্যপ্রস্তর যুগের সর্বাপেক্ষা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এই যে, এই যুগে মানুষের মধ্যে আধিবিদ্যক চেতনার বিশেষ প্রসার ঘটেছিল। ঐতিহাসিক ইরফান হাবিৰ এই পর্যায়ের সমাজকে ধর্মচিন্তা ও কুসংস্কারের উন্মেষের পর্ব বলে চিহ্নিত করেছেন। এই পর্যায়ে মানুষ মৃত্যু পরবর্তী জীবনের চিন্তায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। ফলত তারা মৃতদেহ সমাহিত করার সময় খাবার ভরা পাত্র, মাংসের টুকরো ও গহনাপত্র সব কিছু মৃতদেহের সঙ্গে সমাহিত করতো।
পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যপ্রস্তর ছিল প্রাচীন প্রস্তর ও নব্যপ্রস্তর যুগের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনাকারী পর্যায়। অর্থাৎ, প্রত্নাত্মীয় যাযাবর শিকারী জীবন থেকে এই পর্বে মানুষ আধা যাযাবর, আধা স্থায়ী শিকারী ও পশুপালকের জীবনে উন্নীত হয়েছিল যা নব্যপ্রস্তর বা বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করেছিল।