জাইবাৎসু কারা? অথবা,জাপানের অর্থনৈতিক বিকাশে জাইবাৎসুর ভূমিকা লেখ ৷

জাইবাৎসু কারা? অথবা,জাপানের অর্থনৈতিক বিকাশে জাইবাৎসুর ভূমিকা লেখ ৷

জাইবাৎসু কারা? অথবা,জাপানের অর্থনৈতিক বিকাশে জাইবাৎসুর ভূমিকা লেখ ৷ বা, জপানের জৈবাৎসু শ্রেণির উল্থান লেখ

জাইবাৎসু কারা?

জাপানে শোগুনতন্ত্রের অবসানের পর মেইজি যুগের সূচনা ঘটে। মেইজি যুগে জাপানের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। কৃষিভিত্তিক জাপানী অর্থনীতি পরিণত হয় শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে। এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়া ছিল যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের জন্য মেইজি সরকার জাপানের কতগুলি বণিক পরিবারের শরাণাপন্ন হয়েছিল। জাপানের এই বণিক পরিবারগুলি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সংগঠন স্থাপন করেছিল। এই সংগঠন জাপানী ভাষায় 'জাইবাৎসু' নামে পরিচিত ছিল। 'জৈ' শব্দের অর্থ সম্পদ এবং 'বাৎসু' শব্দের অর্থ গোষ্ঠী। জাইবাৎসু শব্দের আক্ষরিক অর্থ 'সম্পদশালী গোষ্ঠী'। সাধারণভাবে জাইবাৎসু শব্দটি ব্যবহৃত হয় ব্যবসাভিত্তিক যৌথ সংগঠনের ক্ষেত্রে। প্রধান চারটি জাইবাৎসু গোষ্ঠী ছিল মিৎসুই, মিৎসুবিশি, সুমিটামো, যোশুদা। এছাড়াও অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরো চারটি গোষ্ঠী কাওয়াসাকি, ফুরুকাওয়া, তানাকা এবং আসানো অর্থনৈতিক উদ্যোগে অংশগ্রহণ করেছিল।

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন

জাপানে জাইবাৎসু পরিবারগুলি গঠিত হয়েছিল প্রাচীন পরিবারের লোকেদের নিয়ে এবং কিছু নতুন পরিবারে রূপদান। মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর প্রাচীন সামুরাই শ্রেণির লোকেদের শিল্প ও বাণিজ্যে যোগদানের জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল। এরা আর্থিক ক্ষেত্রে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে এবং এদের নেতৃত্বে জাপানের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৯১২ খ্রিস্টাব্দ) জাপানের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে এই অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হলে জাইবাৎসু গোষ্ঠীগুলির হাতে প্রভৃত আর্থিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে জাইবাৎসু গোষ্ঠীগুলি শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

মেইজি যুগের পরবর্তীকালে জাপানে জাইবাৎসুদের নেতৃত্বে দ্রুত আর্থিক বিকাশ ঘটেছিল। প্রথম দিকে এই শিল্পপতিগোষ্ঠীগুলি রাজনৈতিক নেতাদের অনুগত ছিল। পরবর্তীকালে বিপুল অর্থনৈতিক সম্পদ অর্জনের সূত্রে তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এসেছিল তাতে জাইবাৎসুদের বিশেষ অবদান ছিল। জাইবাৎসু গোষ্ঠীগুলি যেমন সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা লাভ করে তেমনি দ্রুত শিল্প বিকাশে ও কৃষির উন্নয়নে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশে ভারী শিল্প যথা-লৌহ ইস্পাত, জাহাজ নির্মাণ, খনি শিল্প প্রভৃতি সংগঠনে জাইবাৎসু গোষ্ঠী জাপানী সরকারকে আর্থিক সহায়তা দান করে। অধিক পরিমাণে উৎপাদন, নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ক্ষেত্রে জাইবাৎসু গোষ্ঠী অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। জাইবাৎস গোষ্ঠীগুলির সহায়তায় জাপান এশিয় ভূখণ্ডে সাম্রাজ্য বিস্তার করে এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করে।

কেবল জাপানী সরকারকে নয় দেশের অন্যান্য উদ্যোগপতি ও বিপন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকেও জাইবাৎসুরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। জাইবাৎসু গোষ্ঠী ব্যান্ড, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করে এবং দেশের অর্থনীতির উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। চেম্বার অফ কমার্স গঠনের মাধ্যমে তারা রপ্তানি শুল্ক দেশের সামরিক ব্যয় হ্রাসের জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। দেশের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংযোগ থাকায় জাইবাৎসুরা প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব বিস্তার করে।

জাপানের অর্থনৈতিক বিকাশে জাইবাৎসুর ভূমিকা সম্পর্কে ঐতিহাসিক ভিনাক উল্লেখ করেছেন, 'জাপানে এমন কোনো শিল্প ছিল না, যাতে জাইবাৎস্ গোষ্ঠী মূলধন বিনিয়োগ করেনি'। জাপানে পুঁজিবাদের বিকাশে জাইবাৎসুদের এক বিশেষ ভূমিকা ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাইবাৎসু গোষ্ঠীগুলি সরকারকে যুদ্ধনীতি ত্যাগ করে শান্তিপূর্ণভাবে আর্থিক অনুপ্রবেশের পথ গ্রহণ করাতে চেয়েছিল এবং ওয়াশিংটন সম্মেলনের পরবর্তী কিছু কাল তারা সাফল্য লাভ করেছিল। শাস্ত্রির পরিবেশে জাপানে দ্রুত শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে। বিভিন্ন পণ্যের শিল্প উৎপাদনে নিযুক্ত থেকেজাইবাৎসুরা জাপানের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। খনিজ সম্পদ উত্তোলন, ধাতু, যন্ত্রপাতি, জাহাজ নির্মাণ, বিদ্যুৎ শক্তি, আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা, বস্ত্রশিল্প, কাঁচ, সিমেন্ট, কাগজ, রাসায়নিক দ্রব্য, ব্যাঙ্ক, বীমা সকল ক্ষেত্রেই তারা অর্থ বিনিয়োগ করেছিল। জাপানের প্রতিটি অর্থনীতি প্রকল্পের সঙ্গে এইভাবে জাইবাৎস শ্রেণি নিজেদের সম্পর্ক স্থাপন করে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে জাপানে তাম্র উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ, কয়লা উৎপাদনের অর্ধেক, বৈদেশিক বাণিজ্যের এক তৃতীয়াংশ, কয়লা উৎপাদনের অর্ধেক, বৈদেশিক বাণিজ্যের এক তৃতীয়াংশ, কাগজ শিল্পের প্রায় সমগ্র অংশ, চিনি উৎপাদন শিল্পের ৪০ শতাংশ ইত্যাদি ছিল জাইবাৎসুদের হাতে। যুদ্ধকালীন জাপানে শিল্পদ্রব্য উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণের ভার ছিল জাইবাৎসু গোষ্ঠীর উপর। তাই জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী যোশিদা মন্তব্য করেছেন, 'আধুনিক জাপান তার শ্রীবৃদ্ধির জন্য জাইবাৎসু গোষ্ঠীর নিকট বিশেষভাবে ঋণী'। আধুনিক ঐতিহাসিক তাকাশি উল্লেখ করেছেন যে, জাইবাৎসু গোষ্ঠীর উদ্যোগে জাপানী সরকারের যেমন অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়িত হয়েছিল তেমনি ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলি সার্থক রূপ পেয়েছিল।

যুদ্ধোত্তর যুগে জাপানের অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের ক্ষেত্রেও জাইবাৎসু গোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। যদিও জেনারেল ম্যাকার্থারের বিরোধিতার ফলে জাইবাৎসু পরিবার-গোষ্ঠীগুলির অর্থনৈতিক প্রভাব বিনষ্ট-প্রায় হয় এবং জাইবাৎসু গোষ্ঠীকর্তৃক নিযুক্ত ম্যানেজারদের (বান্টো) হাত থেকে দেশের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই অপসৃত হয়, তথাপি ম্যাকার্থারের শাসনের অবসানের পর জাইবাৎসুদের পুনরভ্যুত্থান ঘটে এবং পুনরায় জাইবাৎসু পরিবারগুলি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো গঠনে এগিয়ে মিৎসুই, মিৎসুবিশি ও সুমিটামো পরিবারগুলির নিয়ন্ত্রণে স্থাপিত হয়। তবে প্রাক্-যুদ্ধ পর্বে তারা যতদূর প্রভাবশালী ছিল ১৯৬০-র দশকে ততটা ছিল না। তথাপি যুদ্ধোত্তর যুগে জাপানের অর্থনৈতিক পুনরুত্থানে জাইবাৎসুদের অবদানকে উপেক্ষা করা যায় না। জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মেইজি সরকারের পাশাপাশি জাইবাৎসুদের অবদান তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়।

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟