বাংলায় নারী ভাবনায় বিদ্যাসাগরের ভূমিকা কী ছিল? অথবা,সমাজ সংস্কারক হিসাবে বিদ্যাসাগরের ভুমিকা মূল্যায়ন করো। অথবা, নারী মুক্তি ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের ভুমিকা কি ছিল?
বিদ্যাসাগর ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দী তথা নবজাগরণের প্রাণপুরুষ ৷ একদিকে বিদেশি শক্তির প্রভাব অন্যদিকে সমপতিদের দ্বারা শ্রেষ্ঠ ঘুনধরা সমাজ ব্যবস্থা এমন এক অন্ধকার সন্ধিক্ষণের ধুমকেতুর মতো অবস্থায় মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে আবির্ভূত হন মানবসাগর তথা দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর ৷ ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী পরিশ্রমী ও দূরদর্শী ছিলেন ৷ বিদ্যাসাগর সংস্কৃত , ব্যাকরণ,অলংকার,সাহিত্য,শাস্ত্র প্রভৃতিতে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
বিদ্যাসাগর এক দিকে শিক্ষা সংস্কার ও অন্যদিকে সময় সংস্কারে নিজেকেই যুক্ত রাখেন ও নারী সমাজকে শিক্ষার মাধ্যমে বাঁচার প্রেরণা দিয়েছিলেন ৷ আবার বিধবা বিবাহ প্রচলন এর মাধ্যমে দিয়েছিলেন নারী মুক্তির স্বাদ ৷ প্রাচীন ধ্যান ধারণা যুক্ত সামাজিক ব্যাধি নিরশনের রাজা রামমোহন রায়ের পর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার জীবনকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করেছিলেন ৷ তাছাড়া ইংরেজি দ্বারা প্রবর্তিত চুইয়ে পড়া নীতি ছিল দেশীয় শিক্ষা ও গণশিক্ষা বিস্তারে প্রধান বাধা ঘটিতে বিদ্যাসাগর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে নারী শিক্ষায় ব্রতি হয়েছিলেন ৷
বিদ্যাসাগরের সময় সংস্কারের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলো বিধবা বিবাহের প্রবর্তন ৷ বিদ্যাসাগর ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে পরাশয় সংহিতা থেকে উদ্ধৃত করে বলেন বিধবা বিবাহ সম্পন্নরূপে শাস্ত্রসম্মত ৷ তিনি স্পষ্ট করে আরো বলেন সামাজিক ব্যাভিচার ও অকাল বৈদ্যতা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় বিধবার পুনর্বিবাহ ৷ বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য তিনি জনমত গঠনে সচেষ্ট হন ৷ অক্ষয় কুমার দত্তের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তিনি বিধবা বিবাহের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেন ৷ শেষ পর্যন্ত ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ২৬ শে জুলাই বড়লাট ডালহৌসের তত্ত্বাবধানে বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তিত হয় ৷ এরপর বিদ্যাসাগর নিজ পুত্র নারায়ণ চন্দ্র সংগৃত ভবন সুন্দরী নামক বিধবার বিবাহ দিয়ে বিবাহের প্রচলন ঘটায় ৷ এছাড়াও তিনি বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা করেন ৷ তিনি 50000 ব্যক্তির স্বাক্ষর গ্রহণ করে বহুবিবাহের বিপক্ষে আইন করার জন্য সরকারের কাছে এক প্রতিবেদন পাঠায় যদিও তা সফল হয়নি ৷
নারী শিক্ষা বিস্তারে বিদ্যাসাগরের অবদান ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদূর প্রসারী ৷ তিনি মনে করতেন সমাজে নারীদের অবস্থায় উন্নতির জন্য তাদেরকে শিক্ষিত করতে হবে এবং শিক্ষায় সমাজে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারবে তাই নারী শিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগর বেথুন সাহেবের সহায়তায় ১৮৪৯ সালে মেয়েদের জন্য অবেতনিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ৷ যেটি পরে বেথুন বালিকা বিদ্যালয় নামে পরিচিত হন ৷ 1850 সালে ডিসেম্বরে বিদ্যাসাগর বেতন বালিকা বিদ্যালয়ের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ৷ এছাড়াও তিনি গ্রাম বাংলায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ৷
বিদ্যাসাগর কেবলমাত্র বিদ্যালয় গঠন করেই থেমে থাকেননি ৷ সরকারিভাবে আর্থিক সাহায্য পর্যাপ্তনা আসার ফলে তিনি বিদ্যালয়গুলির সঠিকভাবে পরিচালনা ও পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ যোগানির জন্য নারী শিক্ষা ভান্ডার নামক তহবিল গঠন করেন ৷ শুধু তাই নয় বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেছিলেন উপযুক্ত শিক্ষার জন্যই চাই ভালো ভালো পাঠ্যপুস্তক যা শিক্ষার্থীদের কে সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ করতে সাহায্য করবে ৷ তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তকের অভাব পূরণে বিদ্যাসাগর বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেন যেমন,- বর্ণপরিচয় (প্রথম ও দ্বিতীয়ভাগ),বোধোদয় , কথামালা ইত্যাদি ৷
যেহেতু নারী শিক্ষার ধারণা এসেছে পশ্চিম পৃথিবী থেকে তাই উনিশ শতকের নারীর শিক্ষার প্রসঙ্গে এলেই রক্ষণশীল সমাজ পশ্চিমা সভ্যতাকে দায়ী করা হতো । নারী শিক্ষার বিরোধীরা, পশ্চিমা শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে বর্জন করে প্রচলিত সনাতন শিক্ষার কথা বলতেন ৷ এখানেও বিদ্যাসাগর ছিলেন ব্যতিক্রম সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের জন্য তিনি ইংরেজি শিক্ষার উপর বিশেষ জোর দেন ৷ নিজ প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয় গুলিতেও তিনি বাংলার পাশাপাশি ইংরেজ ভাষা আয়ত্তের জন্য ছাত্রীদের তিনি বলত এবং সেভাবে পাঠক্রম তৈরি করতেন ৷
একুশ শতকের শিক্ষা চিন্তাকদের মতো বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে ছিলেন সমন্বয়বাদী দার্শনিক ৷ পাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় অঞ্চলের একটি সমন্বিত শিক্ষায় তিনি শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন ৷ বাংলার নারী শিক্ষার্থীদের বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করে পাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় বুৎপত্তি অর্জন ব্যতীত সামাজিকভাবে বাঙালি উন্নত করতে পারবেন না ৷ তার নারী শিক্ষা মূলক পাঠক্রমে এই সমন্বয়ধর্মী চিন্তার প্রতিফলন লক্ষণীয় ৷ একুশ শতকের এই সমন্বয় খন্ডে আমরা লক্ষ্য করেছি নারী শিক্ষা তথা সামরিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সমন্বয়ধর্মিতার ওপরে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় ৷
বিদ্যাসাগরের নারী ভাবনার একটা উল্লেখযোগ্য দিক ছিল ৷ তার শিক্ষা প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা উনিশ শতকে বাংলায় এই ধারণা ছিল না যে সমাজপতিরা তখন শিক্ষক প্রশিক্ষণের কথা কল্পনাও করতে পারেনি ৷ অথচ বিদ্যাসাগর কত আগেই নারী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কথা ভেবেছেন স্থাপন করেছেন শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল ৷ নারী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠায় রক্ষণশীল সমাজে সু নজরে দেখেননি ৷ এই উদ্যোগের মূল বিদ্যাসাগরকে অনেক ব্যঙ্গ সহ্য করতে হয়েছে ৷ কিন্তু বিদ্যাসাগর কোন কিছুতেই দমে যায়নি নিজস্ব ধারণা অনুসারী পরিচালনা করেছেন নর্মাল স্কুল ৷
একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বিদ্যাসাগর নিজেই ছিলেন রেনেসাঁস অর্থাৎ শিক্ষার মধ্য দিয়ে নারী জাগরণের নারী শিক্ষার বিস্তারনে অন্যতম কান্ডারী বিদ্যাসাগর নিজের সবটুকুই বিসর্জন দিয়ে পরিবার ও গ্রামের সঙ্গে বিচ্ছেদ সাধন করে তিনি তার লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন ৷ বিদ্যাসাগরের আগে পর্যন্ত নারী শিক্ষা বিস্তারে নারীদের জন্য বিভিন্ন স্কুল থাকলেও বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলি সেই সময়ে সারা ভারতবর্ষে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছিল ৷ তাই বলা যায় নারী শিক্ষা বিস্তারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চিন্তাও কর্মদগ্যের সামাজিক তাৎপর্য অপরিসীম ।
🔻গ্রন্থপঞ্জি🔺
🔹বাংলার ইতিহাস(১৭৫৭-১৯০৫) সিদ্ধার্থ গুহ রায়,শ্রেয়া রায