মহাবিদ্রোহী কৃষক শ্রেণীর ভূমিকা লেখো অথবা, তুমি কি এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করো যে কৃষকদের অংশগ্রহণ ১৮৫৭ সালের অভ্যুত্থান সামরিক দিক ও গ্রামীণ চরিত্রের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করেছিল ৷
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে জনগণের অংশগ্রহণ প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বহু মতবিরোধ গড়ে উঠেছে ৷ এই বিতর্কের প্রধান ভিত্তি হল এই যে এই বিদ্রোহ কি শুধুমাত্র সিপাহীদের বিদ্রোহ ছিল ? না এখানে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল সীমিত ছিল ৷ আবার বর্তমান কালের এই বিদ্রোহ সম্পর্কে আরেকটি ভিন্ন ধর্মী ব্যাখ্যা গড়ে উঠেছে তা হল এই যে এই বিদ্রোহীটি কোন বিশেষ শ্রেণীর অন্তগত নয় ৷ কারণ এই বিদ্রোহে বহু শ্রেণি উপজাতি ও কৃষক অংশগ্রহণ করেছিল । সুতরাং সিপাহী বিদ্রোহ সম্পর্কে যে বহু প্রশ্ন উঠে এসেছে তার মধ্যে একটি অন্যতম প্রশ্ন হল এই যে, এই বিদ্রোহে কৃষকদের অংশগ্রহণ একদিকে সামরিক শক্তি অন্যদিকে গ্রামীণ জনগণের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করেছিল কিনা ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
ব্রিটিশরা ১৮৫৭ সালের ২৭ জুন কানপুরে হত্যাকাণ্ডে গামের পর ঘাম নির্বিচারে পুড়িয়ে দেয়, নির্দয়ভাবে স্ত্রী পুরুষ সকলের উপর অত্যাচার করেছিল ৷ শুধু কানপুর নয় ১৮৫৭ সালে ২৯ শে মার্চ কলকাতার নিকটবর্তী ব্যারাকপুরেও মঙ্গল পান্ডে নামে একজন সিপাহী বিদ্রোহ ব্রিটিশদের শঙ্কিত করে তুলেছিল এবং এপ্রিলে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয় ৷ এই দুটি ঘটনার পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে মিরাট,রহিলাখন্ড,লখন ও দিল্লি থেকে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল পর্যন্ত, গাঙ্গেয় দেয়াব থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত ও অযোধ্যা অঞ্চলে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে এবং গণবিদ্রোহের রূপ নেন ৷ যেহেতু অসন্তুুস্ট গ্রামীণ জনগণ এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাই এই বিদ্রোহ শুধুমাত্র তারা সিপাহী বিদ্রোহের সীমিত থাকল না বরং তা কৃষক বা গ্রামীণ অভ্যুত্থানে পরিণত হয় ।
সুতরাং বর্তমানে একটি মূল প্রশ্ন বারবারই বড় হয়ে উঠেছে সিপাহী বিদ্রোহ কি যথার্থ গ্রামীণ জনগণের বিদ্রোহ? না , শুধুমাত্র অসন্তুষ্ট সামরিক শ্রেণীর বিদ্রোহ ? বিদ্রোহে বেঙ্গল আর্মির সেনাবাহিনীর একটি প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল ৷ প্রথমদিকে ওয়ারিং হেস্টিং এর নির্দেশ অনুযায়ী খাওয়া-দাওয়া, স্থানান্তরের যাওয়া এবং জাতিগত নিয়ম কানুন গুলো অন্তত সচেতন ভাবে সেনা প্রশাসন মেনে চলত ৷ কিন্তু ১৮২০ থেকে ৩০ খ্রিস্টাব্দে মধ্যে সেনা প্রশাসনের উপর অধিকর্তা শর্ত নিয়ন্ত্রণ চাপানোর চেষ্টা হয় স্বাভাবিক ভাবেই তা জাতিগত সুযোগ সুবিধা গুলো ছেঁটে ফেলতে শুরু করে । বলা যেতে পারে এইসব ঘটনার বিদ্রোহের পটভূমিকা তৈরি করেছিল আর এই বছর জানুয়ারিতে টোটার গুজবটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিপাহীরা নিশ্চিত হয়ে যায় তাদের ধর্ম জাতকে ষড়যন্ত্র করে ধ্বংস করা হচ্ছে । আর এই ঘটনাটি সিপাহীদের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায় ৷
মাদ্রাজ ও বোম্বাই সেনাবাহিনীর প্রথম দিকে চুপচাপ ছিল অন্যদিকে পাঞ্জাবি ও গোখরা সেনারা কার্যত বিদ্রোহ দমন করতে সাহায্য করেছিল । তবে মনে রাখা দরকার অধিকতরও ভারতীয় সিপাহী ছিল বাংলা দলে ৷ সুতরাং বেঙ্গল আর্মির সেনাদের মানসিকতার সমগ্র ভারতকে প্রভাবিত করেছিল ৷ কিন্তু আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে যে সিপাহীরা ছিল আসলে উর্দী পরা কৃষক । অযোধ্যায় একটি কঠোর রাজস্ব ব্যবস্থা চালু হওয়ায় কৃষি অবনতি ঘটেছিল ৷ ১৮৫৭ সালে অযথা থেকে প্রায় ৭৫ হাজার সেনাকে বেঙ্গল আর্মিতে নিয়োগ করা হয়েছিল ৷ স্যার জেমস উইলিয়াম ডালহৌসিকে বলেছিলেন যে, "অযোধ্যা যেহেতু ডালহৌসের কর্তৃক জোরপূর্বক অধিকৃত হয়েছিল তাই কৃষক মনোভাবাপন্ন সিপাহীরা ব্রিটিশদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিল ৷" শুধু তাই নয়, প্রায় ১৪ হাজার আবেদনপত্র জমা পড়েছিল অযোধ্যার কৃষক সিপাহিদের কাছ থেকে রাজস্ব মুকুবের জন্য ৷ সুতরাং শুধুমাত্র টোটা জনিত কারণেই সিপাহীরা বিদ্রোহ করেছিল তা নয় আসলে এটি ছিল কৃষকদেরই বিদ্রোহ ৷
সিপাহী বিদ্রোহের সঙ্গে কৃষকদের যে অংশগ্রহণ তা ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন কাজ ৷ কারণ ভারতীয় সমাজে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব ছিল নানা রকম ৷ এর আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া ও তাই ভিন্ন ভিন্ন আর যারা বিদ্রোহ করেছিল তাদের মধ্যে দুটি শ্রেণী ছিল ৷ একদিকে ছিল সামন্ত প্রভু ও বড় জমিদার, অন্যদিকে কৃষক সম্প্রদায় ৷ আবার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকমের অভিযোগ ছিল ফলে বিদ্রোহের প্রকৃতিও ছিল ভিন্ন ভিন্ন ৷ যেমন সামন্ত প্রভুদের অভিযোগ ছিল ডালহৌসের স্বত্ব বিলোপ নীতির বিরুদ্ধে । কারন এই নীতির অনুসারী দত্তপুত্রের উত্তরাধিকারী বাতিল হয়ে যায় । আর এইসব রাজ্যগুলো কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় একইভাবে সাঁতারা,নাগপুর,সম্বলপুর , উদয়পুর,ঝাঁসি ব্রিটিশদের হস্তগত হয় ৷
গ্রামীণ সমাজে বড় জমিদার বা তালুকদাররা সিপাহীদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল ৷ কারণ ব্রিটিশরা তাদের দুর্গগুলো ধ্বংস করে দেয়, সমাজে প্রভাব, প্রতিপত্তি ও কমে যায় তারা আইনের চোখে তাদের সঙ্গে আর সাধারণ কৃষকদের কোন পার্থক্য রইল না ৷ সাধারণ কৃষকরাও বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল কারণ রাষ্ট্র অত্যন্ত উচ্চ হাড়ে রাজস্ব আইন অধিকার করেছিল ৷ কৃষকরা বাধ্য হয়ে জমি বিক্রি করে দিয়েছিল ৷ ফলে ১৮৫৭ সালের কৃষকরা বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল তাদের হারানো সম্পত্তির ফিরে পাওয়ার আশায় ।
সুতরাং ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্তরের মানুষ যে অংশ নিয়েছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই ৷ বিতর্ক একটাই যে গ্রামীণ সমাজ এর পশ্চাৎ এ ছিল কিনা ৷ জুড়িথ ব্রাউন মনে করেন যে," এই বিদ্রোহ ছিল সামন্ত প্রভুদের দ্বারা পরিচালিত হয় ৷" আবার মনে করেন ১৮৫৭ সালের এই গ্রামীন বিদ্রোহীরা ছিল মূলত অভিজাত শ্রেণির ৷ এদিক থেকে দেখলে এই বিদ্রোহ কৃষক বা জনগণের ভূমিকা ও তুচ্ছ হয়ে পড়ে ৷ কিন্তু বর্তমান গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে সামন্ত প্রভুদের অনেকেই নেতৃত্ব দিতে অস্বীকার করেছিলেন ৷ যেমন বাহাদুর শাহ অনেক ইতস্তত করে বিদ্রোহের নেতা হয়েছিলেন, কানপুরের নানা সাহেবকে বিদ্রোহী সিপাহীরা ঘেরাও করে নেতৃত্বে দাবি দিয়েছিলেন, ঝাঁসির রানীকে মৃত্যুর হুমকি দেওয়া হয়েছিল যাতে তিনি সিপাহীদের সাহায্য করে, অনেক জায়গায় তালুকদারদের ও কৃষকরা বলপূর্বক নেতা নির্বাচন করেছিলেন ৷ তবে রুদ্রাংশ মুখার্জি দেখেছেন যে,"কেউ কেউ বিদ্রোহীদের পক্ষে নিলেও অনেকে আবার দলত্যাগ ও করেছিলেন ৷ একমাত্র কৃষক এবং হস্ত শিল্পী রায় বিদ্রোহ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন ৷" সুতরাং বিশ্বাসঘাতকতা ধর্মীয় ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা শোষন ইত্যাদির গ্রামের অভ্যুত্থানের মূল কারণ ৷ একথায় মনে করেন বর্তমান গবেষকরা তাদের এই ক্ষোভ এবং অসন্তোষের জন্য তারা সিপাহী বিদ্রোহকে তাদের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে তুলেছিল ৷