মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা কর।

মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা কর।

 মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা কর।

মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা কর।

৮৫৭ সালের বিদ্রোহের স্বরূপ ও প্রকৃতি নিয়ে বাদানুবাদের অন্ত নাই। কারও মতে এটা ছিল সিপাহীদের 'মিউনিটি বা সামরিক বিদ্রোহ। কারও মতে জাতীয় সংগ্রাম, আবার কারও মতে সামস্ত প্রতিক্রিয়া মাত্র। ইংরাজ ঐতিহাসিকদের এক গোষ্ঠী যেমন নর্টন, ডাহু, হোমস্ প্রমুখের মতে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ সিপাহীরা শুরু করলেও কালক্রমে তা জাতীয় আন্দোলনে পরিণতি লাভ করেছিল। কিন্তু ইংরেজ ঐতিহাসিকদের অন্য এক গোষ্ঠী যেমন জন কে, রবার্টস প্রমুখের মতে এটা নিছক সিপাহীদের বিদ্রোহ ভিন্ন আর কিছুই ছিল না। সমকালীন ইংরাজ ও ভারতীয় লেখকরা যেমন- স্যার জন লরেন্স, স্যার সৈয়দ আহম্মদ খাঁ, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যার প্রমুখ এই অভ্যুত্থানকে সিপাহী ও স্বার্থায়েখী মানুষদের যারা সংঘটিত বিদ্রোহ বলে আখ্যাত করেছেন। প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ও চিন্তাবিদ রজনীপাম দত্ত ১৮৫৭ সালের অভ্যুত্থানকে পূর্বতন রক্ষণশীল ও সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলির অভ্যুত্থান হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তদানীন্তন ভারতের বড়লাট লর্ড ক্যানিং ভারত-সচিবকে (Secretary of State for India) লিখিত এক পত্রে মন্তব্য করেন যে, এই বিদ্রোহের ('tebellion') মূলে ছিল ব্রাহ্মণদের প্ররোচনা ও অন্যান্যদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি। তাঁর ভাষায় "the rebel-lion had been fomented by Brahmans on religious pretences and by other for political motives"। জওহরলাল নোফে তাঁর 'ভারত সন্ধান' ('Discovery of India') নামক গ্রন্থে এই বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে খ্যাতনামা স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর সাভারকর ১৮৬৭ সালের অভ্যুত্থানকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন।

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন

১৯৫৭ খ্রীষ্টাব্দে এই বিদ্রোহের শতবার্ষিকী উপলক্ষে দুই খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার ও ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ সেন বহু তথ্য বিচার-বিশ্লেষণ করে এই বিদ্রোহের উপর নূতন আলোকপাত করার চেষ্টা করেছেন। ডক্টর মজুমদার ও ডক্টর সেনের রচিত গ্রন্থ দুইটির নাম যথাক্রমে "The sopoy Mutiny and the Revolt of 1857" ও "Eighteen Fifty Seven"। ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের কোন এক বিশিষ্ট রূপ ছিল না। তাঁর মতে মহাবিদ্রোহ মূলত ছিল সিপাহীদের বিদ্রোহ; কোথাও সিপাহীদের পেছনে ছিল স্থানীয় অভিজাতশ্রেণীর লোক, আবার কোথাও ছিল জনসাধারণের সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় সহানুভূতি। ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ সেন মন্তব্য করেছেন যে, ১৮৫৭ সালের আন্দোলন প্রথমে সিপাহীদের বিদ্রোহরূপেই শুরু হয়েছিল, কিন্তু সর্বত্র তা সিপাহীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর মতে বিভিন্ন অঞ্চলে, এর প্রতি জনসাধারণের সমর্থন ছিল। একথা অনস্বীকার্য যে, প্রথমদিকে মহাবিদ্রোহ ভারতীয় সিপাহীদের মধ্যেই সীমিত ছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে একথাও স্বীকার করতে হয় যে সিপাহীদের কিছু অংশ ব্রিটিশদের প্রতি অনুগতও ছিল। অবশ্য পরবর্তী কালে বিদ্রোহের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটলে হিন্দু ও মুসলমান সিপাহীদের এক বিরাট অংশ এতে যোগ দেয়। ইংরাজ সরকার তথা ইংরাজ ও ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মতামত পর্যালোচনা করলে ১৮৫৭ সালের উত্তোলনকে নিছক সিপাহীদের বিদ্রোহ বা Mutiny' বলে অভিহিত করা অসসত। ভারতের অপর খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ডক্টর তারাচাঁদের 'তাই অভিমত।

মহাবিদ্রোহের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল জনগণের অত্যুত্থান। উত্তর-ভারত ও মধ্যভারতের কোথাও কোথাও সাধারণ মানুষের অভ্যুত্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। যে সব অঞ্চলে সিপাহীরা ব্রিটিশ শাসনের সাময়িক উচ্ছেদ ঘটিয়েছিল, সেখানে সাধারণ মানুষ ঢাল, তলোয়ার, কুঠার, তীর-ধনুক প্রকৃতি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিদ্রোহী হয়। অনেক সময় সিপাহীদের প্রকৃতি বা সামরিক মাত্র। ইংরাজ আদোলনে মানুষদের যারা অনেয় অন্য এক এটা নিছক কালীন ইংরাজ স্বাগান হিসাবে অনুপস্থিতিতেই তারা বিদ্রোহী হয়। অগণিত কৃষক, শিল্পী দলে দলে বিদ্রোহে যোগ দিয়ে সিপাহীদের বিদ্রোহকে গণ-বিদ্রোহের রূপ দেয়, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে। এই দুই অঞ্চলে কৃষক ও পুরাতন জমিদাররা সংঘবদ্ধ হয়ে মহাজন ও নূতন জমিদারদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে নিজেদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। তারা এই সুযোগে মহাজনদের হিসাবের খাতাপত্র ও ঋণের যাবতীয় দলিলপত্র পুড়িয়ে ফেলে। এছাড়া, তারা সরকারী আধালত ও থানা নির্বিচারে আক্রমণ করে ও রাজস্ব-সংক্রান্ত দলিল পুড়িয়ে ফেলে। আনকক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ প্রকাশ্যে বিদ্রোহে যোগ না দিয়েও বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং যেসব সিপাহী ইংরাজ সরকারের প্রতি অনুগত ছিল, সাধারণ মানুষ তাদের কোথাও কোথাও সামাজিক বয়কট করেছিল। তারা সরকারী সেনাদের কোন রকমের সাহায্য দেওয়া থেকে বিরত থাকত এবং অনেক সময় ভুল খবর দিয়ে ভাচ্যের বিভ্রান্ত করত।

মহাবিদ্রোহ দমনের সময় বিদ্রোহের জনপ্রিয়তা প্রকাশ পায়। ইংরাজরা শুধু বিদ্রোহী সিপাহী বা বিদ্রোহী জমিদার, তালুকদার প্রভৃতি সামন্তদের বিদ্রোহ দমন করেই ক্ষান্ত থাকেনি। দিল্লী, অযোধ্যা, আগ্রা, পশ্চিম-বিহার প্রভৃতি অঞ্চলে ইংরাজবাহিনী গ্রামের পর গ্রাম এবং শহরের পর শহর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে এবং অগণিত সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে প্রতিহিংসার জ্বালা মেটায়। বিপ্লবের এই ব্যাপকতা দেখে বেভারেও ভাল্ (Dur) মন্তব্য করেছিলেন যে, ১৮৫৭ সালের অভ্যুত্থানকে সামরিক বিদ্রোহ বলা যায় না-এটা ছিল এক বিপ্লব।** 'লগুন-টাইমস' পত্রিকায় বলা হয়েছিল যে প্রকৃতপক্ষে ইংরাজদের নূতন করে ভারত জয় করতে হয়।

জনগণের সহযোগিতার দিক দিয়ে বিচার করলে বলা যায় যে, অযোধ্যা, রোহিলখণ্ড ও বিহারের কিছু অঞ্চলে সিপাহীদের বিদ্রোহ জাতীয় আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছিল। অযোধ্যার তালুকদার ও তাদের অধীনস্থ জমিদাররা ইংরাজদের সঙ্গে এক প্রচণ্ড সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু পাঞ্জাবে কিছু শিখ সেনা ইংরাজদেরকে নানাভাবে সাহায্য করেছিল। বাংলার শিক্ষিত শ্রেণী মোটামুটিভাবে বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল। জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন ছাড়া কোন আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনের মর্যাদা লাভ করতে পারে না। সেই সময় এক সংখ্যালঘু শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যেই জাতীয়তাবোধ সীমিত ছিল এবং অগণিত দরিদ্র ও নিরক্ষর, জনগণের মধ্যে এই আদর্শের একান্তই অভাব ছিল। সুতরাং সর্বাত্মক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। গড়ে তোলা সে সময় সম্ভব ছিল না।

ভারতের সর্বত্র যে এই বিদ্রোহ প্রসারিত হয়েছিল এমন দাবিও করা যায় না। মাদ্রাজ ও শাজাবে এই বিদ্রোহ মোটেই প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। মহারাষ্ট্রে বিদ্রোহের প্রভাব ছিল সামান্যই। বিদ্রোহ বাংলার শুরু হলেও সাধারণ বঙ্গবাসীর মধ্যে এর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। একমাত্র অযোধ্যা, মধ্যপ্রদেশ ও বিহারের কিছু অঞ্চলে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল এবং তাও ছিল নিতান্তই সাময়িক। ডক্টর মজুমদার এই বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রাম বলে মনে করেন না। প্রথমত, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম বিদ্রোহ বলা যায় না। দ্বিতীয়ত, এই বিদ্রোহের পরিসর ছিল সীমাবদ্ধ। তৃতীয়ত, যদিও হিন্দু। ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় এই বিদ্রোহে অংশ গ্রহণ করেছিল, সব ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক একদ অক্ষুন্ন ছিল না। চতুর্থত, শিখ, মারাঠা, বাজপুতরা এই বিদ্রোহে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেননি। এমনকি অনেকক্ষেত্রে রাজপুত ও মারাঠারা মুসলিম আধিপত্যের পুনঃ প্রবর্তনের সম্ভাবনায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল। বাংলার জনগণও সিপাহী বিদ্রোহের প্রতি মোটেই সহানুভূতিশীল ছিল না। পঞ্চমত, বিদ্রোহের প্রধান প্রধান নেতারা জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন এমন কথা বলা যায় না। প্রকৃতপক্ষে এই বিদ্রোহে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী আদর্শের যথেষ্ট অভাব ছিল। এইসব কারণে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামররূপে চিহ্নিত করা যায় না।

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা কর। এই নোটটি পড়ার জন্য

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟