প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে রাজতরঙ্গিনীর গুরুত্ব আলোচনা কর
উনিশ শতকে ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে যে বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণ, বৌদ্ধিক অনুসন্ধিৎসার সূচনা হয়, তার ফলেই আধুনিক ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে তত্ত্ব ও নিয়মবিদ্যার আবির্ভাব ঘটে। আদি-মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসচর্চার অনেক উপকরণ ও তথ্য থাকা সত্ত্বেও বিদ্যা ও নিয়মের অভাবে বিজ্ঞানসম্মত ঐতিহাসিক গ্রন্থের অভাব দেখা যায়। কিন্তু ওই সময়ে সংস্কৃত ভাষায় লেখা কলহনের রাজতরঙ্গিণীতে সর্বপ্রথম কলহন যে আধুনিক চিন্তা নিয়ে ইতিহাসচর্চা করেছেন, তা স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, "একজন ঐতিহাসিককে বিচারকের আসনে বসতে হবে এবং তাঁকে সবকিছু মুক্ত মন নিয়ে বিচার করতে হবে।" এইদিক থেকে বিচার করলে বলা যায় যে, দ্বাদশ শতাব্দীতে ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে কলহন বিস্ময়কর চিন্তার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।
গ্রন্থটির রচনাকাল ১১৪৮-৪৯ খ্রিস্টাব্দ। প্রাচীন ভারতে রচিত গ্রন্থসমূহের চেয়ে ঐতিহাসিক গ্রন্থ হিসাবে এই গ্রন্থটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ঐতিহাসিক এ. এল. ব্যাসাম তাই বলেছেন,-"The book is unique as the only attempt at the true history in the whole of surviving Sanskrit literature." রাজতরঙ্গিণী আটটি বিভাগে বিভক্ত ও প্রায় ৮,০০০ শ্লোকে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত। শ্লোকগুলি অত্যন্ত উচ্চমানের। তিনি ইতিহাসকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। কাশ্মীরের প্রত্যেক রাজার সিংহাসন আরোহণের তারিখ উল্লেখ করেছেন। কাশ্মীরের মনোরম নদী, শীতল জল, আপেল ইত্যাদির জন্য তিনি তাঁর জন্মভূমিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠস্থান বলে অবিহিত করেছেন। তিনি পরম্পরাগত রাজনীতির পক্ষপাতী ছিলেন এবং আমলাতন্ত্রের বিরোধী। রাজতরঙ্গিণী হল অংশত একটি রাজনৈতিক প্রচারমূলক গ্রন্থ। এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য ছিল দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য শাসকশ্রেণিকে প্রণোদিত করা। তাঁর মতে, আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী হতে দেওয়া উচিত নয়। তিনি বলেছেন কাঁকড়াবিছে যেমন পিতাকে ও উইপোকা যেমন মাতাকে ধ্বংস করে, ঠিক তেমনি অকৃতজ্ঞ কায়স্থ বা আমলা শক্তিশালী হলে সবকিছুই ধ্বংস করে।
কলহন ঐতিহাসিক নিরপেক্ষতা স্বীকার করেছেন। তাঁর সময়কার রাজাদের সম্পর্কে তাঁর সিদ্ধান্ত মোটামুটি সঠিক বলে ব্যাসাম অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কলহন ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ। স্বভাবতই ইতিহাসের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল রক্ষণশীল। তাঁর ইতিহাস চিন্তা কর্মতত্ত্বের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। নিজেদের ইতিহাসকে পরিবর্তন করতে মানুষ একেবারেই অক্ষম, এমন কথা কলহন কোথাও স্পষ্টভাবে বলেননি। ইতিহাসে কলহন অদৃষ্টের ভূমিকাকেও অস্বীকার করেছেন। রাজতরঙ্গিণী গ্রন্থের ঐতিহাসিক গুরুত্ব হিসাবে ব্যাসামের ভাষায় বলা যায়,- "It seems clear that his chronicle was written primarily for readers who already knew the main course of recent history."