উনিশ শতকে বাংলায় নারী শিক্ষা ও নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রগতি ও আধুনিকতার প্রেক্ষিতে পর্যালোচনা কর
মনুষ্য সভ্যতার প্রায় উৎসালগ্ন হতে সমাজ, রাজনীতি, পরিবার সহ সর্বক্ষেত্রে পুরুষ একাধিকত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৷ মনুষ্যজগতের প্রায় অর্ধাংশ মহিলা হওয়ার সত্বেও নারীরা ক্রমশ বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একান্ত ভাবে গৃহচালিনী হয়ে পড়ে নারীদের শরীর পরিচয় শৈশব-কৌশরে পিতা,পরবর্তীতে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্র সন্তান কোনো অবস্থাতেই তাদের সপরিচয় গড়ে ওঠেন নি । ফলোতো নারী জাতির উপরে ক্রমবর্ধমানে চলেছে অবজ্ঞা ও অত্যাচার ৷ তবে আনুমানিক কালে নারী সত্তা ক্রমশ জাগ্রত হতে থাকে, এটি প্রাথমিক পর্যায়ে ইউরোপ বা পাশ্চাত্য দুনিয়ায় শুরু হলে পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের সেই প্রভাব কিছুটা হলেও ছড়িয়ে পড়ে ৷ আর তার ফলেই জেন্ডার স্টাডিস ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করে ৷ ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের পর নারীদের হাতে নব অর্থ আসার পর পর প্রস্তুত হয় যা তাদের আত্ম প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সাহায্য করে ৷ ফলস্বরূপ ফ্যামিনিস্ট মোভমেন্ট গড়ে ওঠে ৷
ভারতের নারী শিক্ষা ও নারী আন্দোলন সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে আমরা যে সকল গ্রন্থের উপর বিশেষভাবে নির্ভর করে থাকি তার মধ্যে অন্যতম হলো সুকর্ণা গুপ্তি সম্পাদিত ইতিহাসে নারী শিক্ষা, মঞ্জু চট্টোপাধ্যায় রচিত নারী শিক্ষা - উনিশ শতকের কিছু কথা, পুলিনবিহারী সেন সম্পাদিত,"জাতীয় আন্দোলনে বঙ্গনারী", বন্দনা সেনগুপ্ত রচিত " স্পন্দিত অন্তর্লোপ", রত্নাবলী চট্টোপাধ্যায়ের গঠিত "ভারত ইতিহাসে নারী", মণিকুন্তলা সেন চিত্রিত "সেদিনের কথা" ইত্যাদি ৷
ভারতবর্ষে জেন্ডার আন্দোলন ও নারী জাতীয় বিকাশের ধারা প্রবাহিত হয়েছে একটি অন্য খাতে ৷ এদেশের নারী আন্দোলনের সূচনা নারীদের সহস্তে না হয়ে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষাবর্তি প্রমুখদের আন্তরিক উদ্যোগে নারী জাতির দুরবস্থা মোচনে হিন্দু সমাজে অমানবিক কিছু প্রথা যেমন সতীদাহ, বাল্যবিবাহ,পুরুষদের বহুবিবাহ,পর্দা প্রথা ইত্যাদির বিরুদ্ধে আন্দোলনের ধারা প্রবাহিত হয়েছিল ৷ তবে পুরুষদের হাতে সূচিত হলেও ক্রমশ নারীরা আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে গ্রহণ করেন ৷ বাংলায় এইরকম একজন নারী ছিলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ৷ এছাড়া ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে মহান নারীদের মধ্যে অন্যতম হলেন পশ্চিম ভারতে পন্ডিতার রামাবাই,দক্ষিণ ভারতে ভগিনী সুব্বালক্সমি প্রমূখ ৷
ভারতে নারী প্রগতি আন্দোলনের বিস্তার সম্ভব হয়েছিল নারীদের মধ্যে ক্রমশ শিক্ষা বিস্তারের হাত ধরে ৷ যদিও নারী শিক্ষা প্রাথমিক পর্যায়ে নানা বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধী কথার মধ্যে পড়েছিল ৷ তবুও প্রাথমিক নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য একটি পৃথক মহিলা বিদ্যালয়ের প্রস্তাব এসেছিল উত্তর পাড়ার জমিদার শ্রীযুক্ত জয়কৃষ্ণ মুখার্জির নিকট হতে ৷ তবে ভারতবর্ষের নারী শিক্ষার অগ্রদূত ছিলেন ওয়াটার বেথুন ৷ তিনি ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে ২১ জন বালিকাকে নিয়ে কলকাতার সুফিয়া স্ট্রিটে রাজা দক্ষিনানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে শুরু করেন ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল ৷ এরপর ডালহাউসের সহযোগিতায় হিন্দু ফিমেল স্কুল স্থাপন করেন ৷ এইসব উদ্যোগে সত্বেও নারী শিক্ষার বিস্তার খুব বেশি আশা জনক হয়ে ওঠেনি । কারণ ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় বিদ্যালয়ে বালক বালিকার আনুপাতিক হাড় ছিল ১০:১ নারী শিক্ষার অগ্রসরতার অন্যতম কারণ ছিল সামাজিক বাধা ৷
তবে শত বাধার সত্বেও নারী শিক্ষা ধীর গতিতে হলেও ক্রমশ বিস্তার লাভ করছিল ৷ কারণ 1987 এর একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছেলেদের কলেজে হাজার জনের মধ্যে ৭৭৮ জন মেয়ে উচ্চশিক্ষা রত ছিল ৷
নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছেন গবেষক জেনাল ডিনস এবং গিল মিনাউল ৷ তাদের গবেষণায় সারমর্ম হল নারী শিক্ষা আন্দোলনের উদ্দেশ্যর মধ্যে নারী মুক্তির বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়নি । এর পেছনে উপনিবেশিক শাসকদের উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত নারীরা যে সন্তানের জন্ম দেবে তারা হবে রাজার অনুগত অন্যদিকে ভারতীয় পুরুষেরা চেয়েছিল জ্ঞান আলোকে প্রাপ্ত নারীরা তাদের আদর্শ সঙ্গিনী হবে ৷ পুরুষ সমাজ চেয়েছিল নারীরা হয়ে উঠুক একদিকে আত্মত্যাগী হিন্দু স্ত্রী অন্যদিকে ভিক্টোরিয়ান যুগের সহধর্মী ৷ শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন নারী শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় স্বাধীস্ত্রী,সুমাতা ও আদর্শ গৃহিনী তৈরি করা ৷
মহিলাদের শিক্ষা সংক্রান্ত পাঠ্যসূচি নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্র ছিল ৷ কেশব চন্দ্র সেনের মত কিছু ব্যক্তিত্বগণ মনে করতেন বিজ্ঞান,অংক,ইতিহাস,ভূগোল ইত্যাদি পড়ার কোন প্রয়োজন নেই ৷ তাদের গৃহ বিজ্ঞান সাহিত্য ধর্ম শাস্ত্র সেলাই ইত্যাদি করা উচিত ৷ কারণ এই সবের মধ্যে দিয়েই মহিলাদের আদর্শ মাতৃত্বের প্রতিক রূপে তুলে ধরা হবে ৷ মঞ্জু চট্টোপাধ্যায় নারী শিক্ষা ১৯ শতকের কিছু কথা গ্রন্থে বলেছেন আসলে সমাজের ধারণা ছিল মেয়েদের স্থান মূলত ঘরের মধ্যেই ৷ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় বলা হয় আমরা মনে করি মেয়েদের এমন সব বিষয় পড়া উচিত যা তাদের যোগ্য স্ত্রী,যোগ্য মাতা হতে সাহায্য করে ৷ তবে শিবনাথ শাস্তির মত কিছু ব্যক্তিত্ব চেয়েছিলেন মহিলাদের পাঠ্যক্রম ছেলেদের মতই হোক ৷
তবে শত বাধার সত্বেও নারী শিক্ষা অতি স্লথ হলেও সামনে থেকে এগিয়ে এসেছে ৷ যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের কাদম্বিনী বসু প্রথম মহিলা স্নাতক সম্মান অর্জন করেন ৷ মহিলাদের জন্য সে যুগে বিশেষ পত্রিকা প্রকাশ শুরু হয় ৷ সেগুলির মধ্যে অন্যতম হলো বামাবোধিনী পত্রিকা, অবলাবান্ধব, মহিলা, দাসী,অন্তরপুর ইত্যাদি ৷ বিদ্যালয় কলেজ শিক্ষার পাশাপাশি চিকিৎসা নার্সিং শিক্ষাতে ও মহিলাদের আগমন শুরু হয় । ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সারদান সাধন নামে এক বিদ্যালয় ১০০ জন মহিলাকে নার্সিং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ৷ মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রকৃত ছিলেন বেগম রোকেয়া ৷ ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন শওকত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল ৷
শিক্ষার পাশাপাশি উপনিবেশিক রাজত্বে মহিলাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণের বিষয়টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ ৷ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় প্রকাশের সভা সমিতিতে নারীরা যোগদান করতে থাকে ৷ স্বদেশী আন্দোলনের সময় বিলিতি দ্রব্য বর্জন, স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার,অরন্ধন পালন,নিষ প্রদীপ প্রভৃতির ন্যায় কর্মসূচি মহিলাদের মধ্য থেকে গৃহীত হয়েছিল ৷ স্বদেশী ব্রত পালনে এগিয়ে আসা মহিলাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কুমোদিনী মিত্র,লীলাবতী মিত্র নির্মলা সরকার,হেমাদিনি দাস প্রমূখ ৷ বিপ্লবীদের আশ্রয় দান এবং অস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার কাজের যেসব মহিলা যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সদাসিনী দেবী,সরোজনী দেবী,ব্রহ্মময়ী সেন, দুকড়ি ওয়ালা দেবী প্রমূখ ৷
ভারতের নারী শিক্ষার উন্নত ঘটালে জাতীয়তাবাদের আন্দোলনের গৌরব উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করলেও পৃথিবীর একাধিক রাষ্ট্রের নেয় নারী সমাজ আজও নানান সমস্যায় জর্জরিত ৷ আমাদের সমাজের Gender bios বা পক্ষপাতিত্ব আজও বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয় ৷ এই বৈষম্য রাজনীতি অর্থনীতির শিক্ষা কর্মক্ষেত্র সর্বত্রই দেখা দেয় ৷ যদিও স্বাধীনতার পর পাশ করা হয় 'Universal adult suffrage','The hindu court' প্রভৃতি আইন ৷ তত সত্বেও অতি সম্প্রতি ২০১১ সালের জনগণের দেখা গেছে ভারতবর্ষের পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাসমান ৷ যার কারণ হলো কন্যা ভ্রুণ হত্যার ন্যায় বিভীষিকা যুক্ত মানসিকতা যা আসলে নারী জাতির দুর্দশা কে তুলে ধরেছে ৷