আদি মধ্যযুগের কৃষি ব্যবস্থার বিবর্তন আলোচনা কর
ভারতে কৃষি চিরকালই ছিল অর্থণীতির মেরুদন্ড । আদি মধ্যযুগেও কৃষি তার ব্যতিক্রম নয়, সমাজের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকে অবলম্বন করেই জিবিকা নির্বাহ করত । সপ্তম শতাব্দীতে, হিউয়েন সাঙ ভারত সফর করেন এবং দেশের উন্নতিশীল ভারত পরিভ্রমন করে এক সচ্ছল কৃষি ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন ৷ ডঃ রামশরণ শর্মা ও ডঃ যাদবের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন ৷ অগ্রাহর ব্যবস্থার প্রবর্তনের ফলে এযুগের কৃষি ব্যবস্থার সামজিক অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন ৷ তাঁদের সঙ্গে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় ও চাম্পকলক্ষী একমত না হয়ে এযুগের সজীব ও সৃজনশীল কৃষি-অর্থনীতির চিত্র তুলে ধরেছেন, তাঁদের সুচিন্তিত অভিমত ও তথ্য দিয়ে ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
এই সমস্ত পতিত জমিগুলিকে ভূমি অনুদানের মাধ্যমে চাষের উপযোগী করা হয়েছিল, যার ফলে কৃষক ও কৃষি সম্প্রসারিত হয়েছিল । একদিকে রাজা ভূমিদানের মাধ্যমে যেমন এইসব অনুৎপাদক ভূমি দান করে দায়মুক্ত হতে চেয়েছিলেন অন্যদিকে, রাজা জমি অনুদানের মাধ্যমে কিছু অর্থ পেতেন, যা রাজাকাশের উপকারে আসত । এইভাবে, ভূমিদান ব্যবস্থায় কৃষি অর্থনীতির বিঘ্ন সৃষ্টি না করে কৃষি উৎপাদনে সহায়তা করেছিল । ডঃ শামা আরও দেখেছেন যে, আদিমধ্য যুগে কৃষির পতন শুরু হওয়ার পরিবর্তে, অগ্রহার ব্যবস্থার ফলে বিরাট পরিমান পতিত জমি এলাকাকে কৃষি উৎপাদনের উপযোগী করে তোলা হয়েছিল ।
এই সময়কালে, কৃষিতে প্রচুর মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল,তার প্রমান হহ এযুগে রচিত কৃষি সংক্রান্ত দুটি গ্রন্থ কৃষিপরাশর ও কৃষিসুক্তি এযুগেই রচিত হয়েছিল এবং আয়ের উৎস হিসাবে এটিকে মর্যাদাও দেওয়া হয়েছিল । এই সময়ে কৃষির ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ছিল, যার ফলে বিভিন্ন ধরনের কৃষি উৎপাদনের প্রচলন ঘটে । পদ্মপুরাণ হতে জানা যায় যে, প্রাচীন বাংলায় পঞ্চাশটি বিভিন্ন রকমের ধান উৎপাদন হত ।
ভারতের উপকূল ভাগে যে প্রচুর পরিমান নারকেল উৎপন্ন হত সে তথ্যপ্রচুর পাওয়া যায় ৷ এমনকি দক্ষিন ভারতে সুপারি ও পানের চাষ ব্যপক সাক্ষ্য পাওয়া যায় বিভিন্ন লেখতে ৷ আদি মধ্যযুগের বাংলায় পানের চাষ হত বেশ তথ্য পাওয়া যায় ৷ বিশেষ করে, দীনেশ চন্দ্র সেনের একটি লেখতে উল্লেখিত "বারজিক" শব্দের অর্থ করেছেন "বরজ" যার মানে হল "পানের চাষী" । গুজরাট এবং দাক্ষিণাত্যে, তৈলবীজ এবং কার্পাস ব্যাপকভাবে জন্মেছিল ৷ একটি পুরানো নথি থেকে জানা যায় যে বাংলাদেশও তুলা উৎপাদন করত । মালাবার অঞ্চলে যে মশলা বা গোলমরিচ উৎপাদন হত তা সীট খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে লেখা পেরিপ্লাসে পাওয়া যায়, অন্যদিকে কাশ্মীরে যে জাফরান উৎপাদন হত কলহনের রাজতরঙ্গিনীতে তার উল্লেখ আছে ।
তখনকার দিনে কী পদ্ধতিতে চাষ হত সে সম্বন্ধে বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও, তবে মনে হয় বর্তমান পদ্ধতির ও পুরানো পদ্ধতির মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য ছিল না । তবে কৃষি পণ্য সাধারণত একই ছিল সেকালে তামাক, চা, কফি মতো কিছু কিছু নতুন দ্রব্য ছাড়া প্রায় সবই উৎপাদন হত । তবে পার্ট সে যুগে উৎপাদিত হলেও এখনকার মতো ব্যপক চাষ হত না । ভেষজ লতাপাতা, মশলা, সুগদ্ধি,কাঠ অধিক পরিমানে উৎপাদন হত, তথাপি পার্থিয়ান যুগে উৎপাদিত হওয়া সত্ত্বেও, এটি ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়নি । ধান এবং আম বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ করা হত, কিন্তু প্রধান ফসল ছিল তৈলবীজ, জোয়ার, তুলা, মটরশুটি, চাল, তিল এবং বিভিন্ন ধরণের ডাল যার বাইরেও চাহিদা ছিল । কালিদাসের সাহিত্য ও বানভট্টের হর্ষচরিতেও বিভিন্ন ধরনের ধান উৎপাদনের তথ্য পাওয়া যায় ।
ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর সংস্কৃতি গ্রন্থে লিখেছেন যে "গুড়, হতেই বাংলার রাজধানী গৌড়ের নামকরন হয়েছে ।" সেযুগেও আখ ও ধান দুটিই ছিল অর্থকারী ফসল, অমরকোষ নামক গ্রন্থে ও তুলা, তিল, সর্ষে ও নীল চাষের উল্লেখ আছে, প্রয়াসের সন্নিকটস্থে জমি সব থেকে উর্বর ছিল এবং এখানে উৎকৃষ্ট মানের ধান, আম ও গম উৎপন্ন হত । ফলের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ফল ছিল আম এবং অন্যদিকে সিরসূতী চাল উন্নতমানের শস্যগুলির অন্যতম ছিল । গাঙ্গেয় সমভূমির বাইরে ভারতের বিভিন্ন স্থানে আমের চাষ হত তা বিভিন্ন তথ্যে জানা যায় । জিয়াউদ্দিন বারনি ও আফিফের বিবরনে জানা যায়,"অন্যান্য ফলের মধ্যে আঙুর, খেজুর, বেদানা, কলা, ভারতীয় তরমুজ, পীচ, আপেল, কমলালেবু মৌসম্বী, ডুমুর, লেবু,জাম, কাঁঠাল, এবং আরও নামারকম ফল উৎপন্ন হত ।"
ফুল ও ফুলের মালা ভারতীয় সমাজব্যবস্থার সঙ্গে আদি থেকে অন্তঃ পর্যন্ত জড়িয়ে আছে, বিবাহ হতে শশ্মান পর্যন্ত এবং নানা আঞ্চিলিক অনুষ্ঠানে ফুলের কদর আজও অটুট আছে । ভারতে উৎপন্ন চন্দন ও ঘৃতকুমারীর সুগদ্ধ যুক্ত কাঠের খ্যাতি ছিল, মন্দিরে এই কাঠ অর্থ হিসাবে নিবেদিত হত ৷ এই কাঠে শ্মশান বানাও হত, এই কাঠ থেকে কিছু উদ্ভিদ পাওয়া যেত যেগুলি বিষ ও সর্প শনের প্রতিষেধক হিসাবে ব্যবহৃত কিছু কিছু ভেষজ উৎপন্ন হত । গুজরাটের কিছু অঞ্চলে, লবঙ্গ, আদা এবং অন্যান্য মশলা প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হত, এই সময়ে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের পরিমাণ এবং বৈচিত্র্য কৃষির অর্থনৈতিক তাৎপর্যের স্থিরতার প্রমাণ দেয় ।
কৃষিউৎপাদনের এই সম্প্রসারন এযুগে সম্ভব হয়েছিল । কাঠের লাঙল চাষের প্রসার হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তা সেই সময়ের কৃষি অর্থনীতির লক্ষণ ৷ ঢেঁকি থেকে তৎকালীন কৃষি অর্থনৈতিক জীবনের পরিচয় পাওয়া যায় । যদিও ভারতীয় কৃষি বেশিরভাগই বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভরশীল ছিল, সেচ ব্যবস্থাও এই সময়ে তৈরি হয়েছিল । সুদর্শন বাঁধ নির্মাণের সুবাদে মৌর্য ও গুপ্ত যুগেও একটি সেচ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় । যাইহোক, ভারতে সুবর্ণযুগেই কূপ বা পুকুর খননই ছিল সবর্ণ যুগের সেচব্যবস্থার সর্বশ্রেষ্ঠ পথ, সেযুগে গুজরাট ও রাজস্থানে সেচব্যবস্থা যে প্রসারিত হয়েছিল তা প্রখ্যাত গবেষক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় তাঁর গবেষনায় দেখিয়েছেন ৷ গবেষক রণবীর চক্রবর্তীর মতে, এযুগে সেচের কাজে যে যন্ত্রটি ব্যবহার হত তাঁর নাম 'অরঘট্ট' । রামপাল যে একটি বড় দীঘি তৈরি করেন তা, সন্ধাকর নন্দী রচিত রামচরিত গ্রন্থে সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় । দক্ষিন ভারতে চোল রাজাদের জলাশয় খননের ঐতিহ্য ছিল সে তথ্য বিভিন্ন চোল লেখতে পাওয়া যায়, সেচ ব্যবস্থা পরিচালনায় চোল স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থায় গ্রামসভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ৷
এযুগে কৃষি সম্প্রসারন ঘটলেও কৃষকের অবস্থা বা পল্লিবাসীর অবস্থা প্রকৃতই কেমন ছিল সে তথ্য খুবই অল্প ও ভাসাভাসা পাওয়া যায় । এতদসত্ত্বেও, এটা অনস্বীকার্যভাবে সত্য যে তাদের অবস্থা ছিল ভয়ানক, কৃষকদের বিভিন্ন ধরনের শুল্ক দিতে হয়েছিল । ডক্টর আসরাফ বলেছেন যে,"গ্রামীণ জীবনে অন্য শ্রমিক শ্রেণীর তুলনায় কৃষক শ্রেণী বেশি কষ্ট সহ্য করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই । বছরের অধিকাংশ সময় দিন কাটত অনাহারে , কৃষক জীবনের এই চরম দারিদ্র্যের ছাপ সেযুগে বহু তথ্যে পাওয়া যায়না ।" তবে কৃষকের জীবন-যন্ত্রণা ও দুর্দশা সম্পর্কে আমির খসরু যা বলেছেন," এযুগে কেন সবযুগের কৃষক সম্পর্কে প্রযোজ্য তিনি বলেছেন "সম্রাটের রাজমুকুটের মুক্তো যে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে তা কৃষকের চোখের জলের কেলাসিত রূপ ৷”