ফরাসী বিপ্লব কি বুর্জোয়া বিপ্লব?

ফরাসী বিপ্লব কি বুর্জোয়া বিপ্লব?

 ফরাসী বিপ্লব কি বুর্জোয়া বিপ্লব?

ফরাসী বিপ্লব কি বুর্জোয়া বিপ্লব?

১৭৮৯ সালের ১৪ই জুলাই বাস্তিল দুর্গের পতনের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত ফ্রান্সের ফরাসী বিপ্লব বিশ্ব ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরির্তনের সূচনা করেছিল। মূলত সামাজিক, অর্থনৈতিক দিক থেকে অধিকারভোগী শ্রেণীর (যাজক ও অভিজাত) বিরদ্ধে অধিকারহীন শ্রেণীর (বুর্জোয়া, কৃষক, শ্রমিক, সাকুলে প্রভৃতি) এই বিপ্লব ফ্রান্সে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার সূচনা করেছিল। তৃতীয় এস্টেট (অধিকারহীন) নিজেকে জাতীয় সভা হিসাবে ঘোষণা করে রাজার স্বৈরাচারী ক্ষমতার বিরোধিতা করেছিল। সাংবিধানিক সভা ১৭৮৯ সালের ২৬শে আগস্ট ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকার ঘোষণা (Declaration of the Right of Man and Citizen) করে সকল মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথকে প্রশস্ত করে। জাতীয় সভা ফ্রান্সের জন্য একটি সংবিধান রচনার কাজে ব্রতী হলে এই সভা সংবিধান সভায় রূপান্তরিত হয়। সংবিধান সভা ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে সংবিধান রচনার কাজ আরম্ভ করেছিল, ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে তা শেষ হয়।

আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন


কিন্তু সাম্প্রতিককালে ঐতিহাসিকদের মধ্যে অর্থনৈতিক ইতিহাসের যে বিষয়গুলি নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে, তা হল ফরাসী বিপ্লবের চরিত্র বা প্রকৃতি নির্ণয় করা। উল্লেখ্য অর্থসঙ্কটে অসহায় এবং অভিজাত বিদ্রোহে ভীত ফরাসী রাজ যোড়শ লুই ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গিয়েছিল বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতেই যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। অধিকারহীন তৃতীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেছিল ধনী ব্যবসায়ী, ব্যাঙ্কার ও চাকুরীজীবী বুর্জোয়ারা। কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতেই সমস্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল।


ষোড়শ লুই জাতীয় সভা ডাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর সকল শ্রেণীর প্রজাদের কাছ থেকে জাতীয় সভা সম্পর্কে তাদের প্রস্তাব ও অভিযোগগুলি জানাতে কেহিয়ার্স বা আবেদন পত্র পাঠাতে বলেন। উল্লেখ্য তৃতীয় শ্রেণীর পক্ষ থেকে যে কেহিয়ার্সগুলি আসে তা গুরুত্বপূর্ণ। এই কেহিয়ার্সগুলি রচনার সময় বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবিরাই প্রধান ভূমিকা নেয়। ঐতিহাসিক কোব্বানের মতে, শহুরে অধিবাসীদের কেহিয়ার্সে স্বচ্ছল কৃষকদের অভিমত প্রতিধ্বনিত হয়। কেহিয়ার্সগুলিতে জমি বন্টনের দাবী ছিল না। লাফায়েৎ বা মিরাবু্যু (বুর্জোয়া নেতৃবৃন্দ) সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের বিপক্ষে ছিলেন না। প্রধানত অপ্রতিহত স্বৈরতন্ত্র থেকেই বুর্জোয়া শ্রেণী মুক্তি চেয়েছিল। অর্থবান ও ক্ষমতাসম্পন্ন উচ্চ শ্রেণীর বুর্জোয়ারা পুরানো ব্যবস্থায় নিজেদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের বাধাকে সরাতে চেয়েছিলেন।


জাতীয় সভার অধিবেশন বসলে দেখা যায় এই সভার ১২১৪ জন মোট সদস্যদের মধ্যে যাজক ও অভিজাতদের মোট সদস্য ছিল ৫৬০ জন এবং তৃতীয় শ্রেণীর সদস্য ছিল ৬২১ জন। তৃতীয় শ্রেণীর পক্ষে প্রধানত বুর্জোয়ারাই নির্বাচিত হয়। তৃতীয় শ্রেণীর সদস্যদের মধ্যে আইনজীবী ছিল ২০%, চাকুরিজীবি ৫%, বণিক ও শিল্পপতি ছিল ১০%, কৃষকের প্রতিনিধি ছিল ৭-৯৯। ইতিমধ্যে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবিদের প্রচার ও যুক্তির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বেশ কিছু যাজক ও কিছু অভিজাত নিজ নিজ শ্রেণী ত্যাগ করে বুর্জোয়া সদস্যদের সঙ্গে যোগ দেয়।


একদিক থেকে এই বিদ্রোহকে বিপ্লব' বলা যায়। কারণ অভিজাত ও যাজক এই দুই সুবিধাভোগী শ্রেণীর চিরাচরিত বৈষম্যমূলক অধিকার নাশ করার কাজে বুর্জোয়া শ্রেণী সক্রিয় উদ্যোগ নিয়েছিল। যদি শ্রেণীসংগ্রামকে 'বিপ্লব' বলা হয়, তবে বুর্জোয়া শ্রেণীর এই সংগ্রাম ছিল বিপ্লব। তাছাড়া বুর্জোয়া নেতারা যে বিপ্লবী সংবিধান রচনা করে তা সামন্তপ্রখার মৃত্যু ঘণ্টা বাজায়। বুর্জোয়া বিপ্লব দ্বারা স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের পতন তরান্বিতহয়। বুর্জোয়া শ্রেণী যে নতুন সংবিধান রচনা করেন তাতে ফরাসী দার্শনিক মন্তেস্তর 'ক্ষমতা বিভাজন নীতি অনুসরণের মাধ্যমে রাজার ক্ষমতা হ্রাস করা হয়।


কিন্তু কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন যে, বুর্জোয়া শ্রেণীর জয়লাভের ফলে কোনো আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন সঙ্গে সঙ্গে ঘটেনি। এমনকি রাজতন্ত্রও বহাল ছিল। বুর্জোয়ারা অভিজাতদের বিশেষ অধিকার কেড়ে নিয়ে রাজনৈতিক ও শাসন ক্ষমতা নিজ শ্রেণীর হাতে ন্যস্ত করে। তারা সর্বসাধারণের ভোটাধিকার দ্বারা গ্রামীণ কৃষক ও শ্রমিকদের ভোটাধিকার না দিয়ে সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটাধিকার চালু করে। ফলে সম্পত্তিভোগী বুর্জোয়া শ্রেণী রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্রায়ত্ত্ব করে। সুতরাং এই সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিপ্লবকে 'প্রকৃত বিপ্লব বলা যায় না।


কোনো কোনো গবেষক বুর্জোয়া শ্রেণীর বিপ্লবকে প্রকৃত বিপ্লব বলতে আপত্তি প্রকাশ করেছেন। কারণ বুর্জোয়া শ্রেণী রক্তপাত ও হিংসার পথে না গিয়ে রাজনৈতিক ও আইনের চাপে জাতীয় সভায় তাদের অধিকার আদায় করে। যদিও খুব শীঘ্রই সাকুলেৎ ও জনসাধারণ বুর্জোয়াদের ক্ষমতাচ্যুত করে। এইভাবে বুর্জোয়া বিপ্লব শেষ পর্যন্ত জাতীয় বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করে।


সাংবিধানিক সভার বুর্জোয়া সদস্যরা সম্পত্তির অধিকারকেই একমাত্র পবিত্র অধিকার বলে গণ্য করত। এই কারণে এই সভা ফ্রান্সের সকল নাগরিককে সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটাধিকার দেয়। ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন এই কারণে বলেন যে, যাজক, অভিজাত ও সাধারণ লোকের পরিবর্তে এই সংবিধান পাউণ্ড, সিলিং ও পেনীর ভিত্তিতে নতুন শ্রেণী গঠন করে। ভোটাধিকার নীতির এই বঞ্চনার ফলে ফ্রান্সের প্রায় ৩০ লক্ষ নাগরিক ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, মানব জাতির ঘোষণাপত্রে সাংবিধানিকসভা রুশোকে অনুসরণ করে বলে যে, "সকল মানুষ স্বাধীনতা ও সমান অধিকার নিয়ে জন্মায়। তাহলে এই ৩০ লক্ষ নাগরিককে সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সংবিধান সভা পরস্পরবিরোধী কাজ করেছিল। ফ্রান্সে বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সকল নাগরিকদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত করার ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। কৃষক ও সাকুলেই সম্প্রদায়কে বঞ্চিত করে বুর্জোয়ারা সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। লেফেভর-এর মত ঐতিহাসিক বলেন যে, সংবিধান সভা ফ্রান্সে অর্থনৈতিক সমতার দিকে নজর না দিয়ে পুঁজিবাদী বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে ৷

আরও জানতে ভিডিও টি দেখতে পারেনঃ

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ফরাসী বিপ্লব কি বুর্জোয়া বিপ্লব? এই নোটটি পড়ার জন্য

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟