সেফটি ভালভ তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের উত্থান ব্যাখ্যা করে 'সেফটিভার তত্ত্ব' সম্পর্কে একটি টীকা লেখো।

সেফটি ভালভ তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের উত্থান ব্যাখ্যা করে 'সেফটিভার তত্ত্ব' সম্পর্কে একটি টীকা লেখো।

সেফটি ভালভ তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের উত্থান ব্যাখ্যা করে 'সেফটিভার তত্ত্ব' সম্পর্কে একটি টীকা লেখো।


সেফটি ভালভ তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর

 

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের পরে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী অন্ধ সাম্রাজ্যবাদী, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শোষণ, উগ্র বর্ণবিদ্বেষ ও সামাজিক বৈষম্য প্রভৃতি অনুসরণ করতে থাকে। ফলে শাসক ও শাসিতের মধ্যে বিভেদের ব্যবধান ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ কর্মচারীরা পর্যন্ত অতি দাম্ভিক ও অশালীন আচরণ করতে শুরু করে। এই উগ্ন বৈষম্যমূলক আচরণের সঙ্গে যুক্ত হয় ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ভারতীয়দের বিরাগ।


ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধো যথেষ্ট মতভেদ দেখা যায়। অনেকেই মনে করেন যে, প্রধানত সাম্রাজ্যবাদীর দৃষ্টিভঙ্গীর দ্বারা পরিচালিত হয়েই অ্যালান অক্টেভিয়ান হিউম এই সর্বভারতীয় সংস্থা গঠনে ব্রতী হন। মার্কসবাদী লেখক রজনীপাম দত্ত মনে করেন, ভাইসরয় ডাফরিনের সাথে গোপন ষড়যন্ত্র ও ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ পরিচালনা ও পক্ষপাতিত্বের ফলশ্রুতি হল জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা এবং এর উদ্দেশ্য ছিল ভারতবাসীর ক্রমবর্ধমান ব্রিটিশবিরোধী বিক্ষোভ ও মনোভাবের হাত থেকে ব্রিটিশ শাসনকে সুরক্ষিত করা।


এসবের পরিণতিতেই ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয় মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সন্তানেরা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে রাজনৈতিক প্রতিবাদসূচক সভাসমিতি গঠনে উদ্যোগী হন। ঐতিহাসিক অনিল শীল এই প্রতিবাদী যুগটিকেই 'Age of Associations' বলে বর্ণনা করেছেন। এই প্রগতিবাদী ভারতীয় ভাবধারার কল্যাণেই ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় "ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস।"



তিনি মনে করেন জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশ সরকার এক অবশান্তাবী বিদ্রোহ দমন বা বানচাল করতে সমর্থ হয়। তাঁর কথায় সরকারের নীতির দিক থেকে বিচার করলে বলা যায়, জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা এক আসন্ন বিপ্লবকে বাথ বা অঙ্কুরে বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা মাত্র। এ যাবৎ যে সকল নথিপত্র ও প্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে এরূপ ব্যাখ্যাই সমর্থিত হয়। দাক্ষিণাত্যের কৃষক বিদ্রোহ, ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা, অস্ত্র আইন-প্রসূত গণবিক্ষোভ ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে এক অস্বস্তিকর ও আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল।


হিউম নিজেই স্বীকার করেছেন, 'আমার মনে তখন বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না যে আমরা তখন এক ভয়ঙ্কর বিপ্লবের চূড়ান্ত বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলাম।' ভারতে ক্রমবর্ধমান ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভ ও অশান্তির পটভূমিতে হিউম জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি 'সেফটি ভাল্ভ' তৈরি করতে প্রয়াসী হন যার মাধ্যমে শিক্ষিত ভারতবাসী সশস্ত্র বিদ্রোহের দিকে না ঝুঁকে বিধিসম্মত উপায়ে তাদের অভাব-অভিযোগ উত্থাপন করার সুযোগ পাবে। হিউমের নিজের ভাষায়, 'আমাদের কাজের ফলে যে ক্রমবর্ধমান শক্তির উদ্ভব ঘটেছে তার নিরাপদ বহির্গমনের জন্য একটি ভালভের জরুরী প্রয়োজন।


বলাবাহুল্য শাসকগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে মজবুত করার জন্য যে কংগ্রেস গঠন করা হয়েছিল, সেখানে শ্রমিক কৃষকের কোনো স্থান থাকতে পারে না। সেজন্য হিউম ১৮৮৩ বিঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের উদ্দেশ্যে একখানা খোলা চিঠি প্রকাশ করে তাদের মানসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক উৎকর্ষ লাভের জন্য একটি স্থায়ী সংস্থা গঠনের উপদেশ দেন। এরূপ সংস্থার প্রতি তিনি সরকারি সমর্থনের আশ্বাসও দেন। এছাড়া ব্রিটিশ সরকার শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে যেভাবে প্রতিনিধি নির্বাচণ করেছিলেন তাতেও এই ষড়যন্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়।


 ব্রিটিশ সরকারের অবাঞ্ছিত ব্যক্তিরূপে পরিচিত তথাকথিত উগ্রপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুম্বইতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে সভাপতিরূপে নির্বাচিত না করে এই সভার দায়িত্ব দেওয়া হয় নরমপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে। 



এইসব চিন্তাশীল ব্রিটিশ আমলাবৃন্দ মনে করেন সরকার কর্তৃপক্ষের উচিত হবে শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির শাসন- সংস্কারের দাবিগুলি সহানুভূতির সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করা এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতবাসীর আস্থাভাবকে জাগ্রত করা। প্রখ্যাত আমলা এ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম সর্বপ্রথম এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে ভারতীয়দের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ও বিক্ষোভের প্রশমনে কিছু একটা করতেই হবে, নতুবা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য। তিনি এমন এক অদ্ভুত সংকটের সংকেত বুঝেছিলেন এবং তার প্রতিকারের পন্থা হিসাবে তাঁর প্রখ্যাত "সেফটি ভালভ” তত্বটি প্রচার করেছিলেন। তিনি মনে করেন প্রয়োজনমত ভারতীয় জনমতকে যাচাই করার জন্য শিক্ষিত ভারতীয়দের একটি জাতীয় সংগঠনের ভূমিষ্ঠ হওয়ার দরকার আছে। শুধু সামাজিক সংস্কারই নয়, প্রয়োজনে রাজনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্র হিসাবে এমন প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সরকার বাহাদুরের অবিরাম যোগাযোগ থাকা প্রয়োজন। বলা হয় লর্ড ডাফরিন (১৮৮৪-১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দ) এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি সিভিলিয়ান হিউমের ধারণার অনুকূলে মতামত দেন। তাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫ খ্রিঃ)। ভারতের শিক্ষিত মহলে দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ ও নৈরাশ্যজনক অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার পন্থা হিসাবে জনগণের পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ যাতে হিংসাত্মক পথে যেতে না পারে-ব্রিটিশ শাসনকে আসন্ন বিপদ থেকে মুক্তি দেওয়ার পথ বাঁধাই করার জন্যেই নিরাপত্তার খোঁজ অবশেষে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আবির্ভাব ঘটায়। লর্ড ডাফরিন জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে ভারতের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান করতে চান। এইভাবে হিউমের "নিরাপত্তা ভাল” তত্ত্বটি কার্যকর করা হয়।


About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟