জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট লেখো?

১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হল ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা । কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা মাত্র দুই দশকের মধ্যে এই দলটি ভারতের রাজনৈতিক জীবনে বটবৃক্ষের ন্যায় একটি প্রধান জাতীয়তাবাদী সংস্থায় পরিণত হয় । এই কংগ্রেসকে কেন্দ্র করেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম আবর্তিত হতে থাকে । বিংশ শতকে কৃষক, শ্রমিক,যুব ও ছাএ সম্প্রদায় সকলেই কংগ্রেসের ছায়া তলে জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেয় । জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ভারতের রাজনৈতিক জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে । ইংরেজ সিভিলিয়ন কর্মচারী অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লেখেন । এই চিঠির দ্বারা ভারতীয় জনসাধারণের মানসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নতি সাধনের জন্য একটি সংগঠন গড়ে তুলতে আহ্বান করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হয়।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
ভারতের বিচ্ছিন্ন অবস্থাকে ঐক্যবদ্ধ করার কোন ইচ্ছা ব্রিটিশ সরকারের ছিল না তারা ভারতের জাতিগত পার্থক্য ও বিভেদকে কাজে লাগিয়ে ঔনিজেদের শাসনব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করতে চেষ্টা করে। কিন্তু শিক্ষিত ভারতবাসীই ইংরেজ শাসনের নীতি জানতে পেরেই জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলেন । তাদের চেষ্টায় ভারতের সমস্ত শ্রেণীর মানুষ ধনী নির্ধন, জমিদার প্রজা, ছাএ শিক্ষক ব্যবসায়ী প্রভৃতি সকলেই জাতীয় আন্দোলনের অংশীদারী হন । যে সংগঠনের মাধ্যমে তারা এই সুযোগ গ্রহণ করেন তাহাই হল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস।
পট্টভি সীতারাম মাইয়ার লেখা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ইতিহাস নামক গ্রন্থে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের উৎপত্তিকে রহস্যাবৃত বলে মনে করেছেন ৷ । তিনি আরও বলেন কংগ্রেসের মতো একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কথা আলোচনা করা হচ্ছিল । হিউম এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ১৮৮৫ সালের মার্চ মাসে বোম্বাই শহরে 'ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন' নামে এক সর্বভারতীয় সভার অধিবেশন আহ্বান করেন । পরবর্তীকালে এই সমিতির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস । গোপাল কৃষ্ণ গোখলে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার সম্পর্কে এই অভিমত প্রকাশ করে তিনি বলেন," কোন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রসর হতেন তাহলে ব্রিটিশ সরকার অবশ্যই সে প্রচেষ্টা ব্যাহত করত।"
হিউম ছিলেন এক প্রভাবশালী সরকারী আমলা । ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে তিনি এই প্রতিষ্ঠানটি গঠনে অগ্রসর হন । হিউম আশঙ্কা করেন যে ভারতবর্ষে এক দারুন বিপ্লব আসন্ন এবং শিক্ষিত ভারতবাসীর এক অংশ এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত । ভারতীয়দের অসন্তোষ প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে তিনি সামাজিক ও প্রশাসনিক বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি সর্বভারতীয় সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দেন । হিউম প্রথমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে তাদের দেশের জন্য জনকল্যাণমূলক কাজে অগ্রণী হতে আহ্বান জানান । লর্ড ডাফরিনের সহায়তা তিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিস্ট ইউনিয়ন নামে একটি সংগঠন স্থাপন করেন । পরেই ইহাও জাতীয় কংগ্রেস নামে পরিচিত লাভ করেষ।
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বরে বোম্বাইয়ে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসে । কলকাতার খ্যাতনামা ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। সভাপতির ভাষণে তিনি কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে কিছু কথা ঘোষণা করেন।1) ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে যারা দেশের সেবায় ব্রতী তাদের মধ্যে পরিচয় স্থাপন করা। 2) এই পরিচয় এর মাধ্যমে জাতি ধর্ম ও প্রাদেশিকতার সংকীর্ণতা দূর করে জাতীয় ঐক্যের পথ প্রশস্ত করা। 3) শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে আলাপ আলোচনার দ্বারা সামাজিক সংস্কার ও সমস্যার সমাধানের পথ নির্ধারণ করা।4) রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য পরবর্তী বছরের কর্মসূচি গ্রহণ করা।
এই দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলনের সাফল্যেই হিউম শঙ্কিত হন। তিনি বোম্বাইয়ের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কর্মীদের উৎসাহ দিয়ে এটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। এভাবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়।
সাধারণত হিউম কে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা বলা হলেও হিউম নিজে তাহা অস্বীকার করেছিলেন। গভীরভাবে বিচার করলে হিউমকে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় না কারণ একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ বহুদিন থেকে সচেষ্ট ছিলেন। তারা সকলেই তৎকালীন ইংরেজ সরকারের শোষণ মূলক নীতির বিরোধী ছিলেন। তারা এমন একটি রাজনৈতিক সংগঠন স্থাপনে উদগ্রীব ছিলেন যার মাধ্যমে ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির সম্ভব হবে। তাদের স্বদেশ প্রেমে কোনরকম ভেজাল ছিল না। অতএব তারা যে ইংরেজ সরকারের সহায়তায় কংগ্রেস স্থাপন করেন, তাহা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে তৎকালীন ভারতবর্ষে প্রথম থেকে সরকার বিরোধী কোনো সংগঠন স্থাপন করা সম্ভব ছিল না। ইংরেজ সরকার ইহা জানতে পারলে কখনোই অনুমতি দিত না। এজন্য ইউমের ন্যায় ব্রিটিশ সরকারের একজন বিশ্বাসভাজনের সাহায্যেই ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক নতুন পথে পরিচালিত হতে থাকে। লর্ড ডাফরিনের প্রস্তাব বা হিউমের পরিকল্পনা কংগ্রেসের উদ্ভবের প্রধান কারণ নয়। ভারতের সর্বোত্র যখন জাতীয়তাবোধ দেখা দেয় রাজনৈতিক সচেতনতা জোরদার হয়, জাতীয় ঐক্যের অনুভূতি শিক্ষিত জনসাধারণের মনে উদয় হয় তখনই ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের আবির্ভাব হয়।