মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতি আলোচনা কর
মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব ইসলামের প্রকৃত সেবক হিসাবে ইসলামীয় আদর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্র নীতি নির্ধারণের উদ্যোগ নেন ৷ কোরআনে বর্ণিত সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ধর্মীয় আইন অনুসারে রাষ্ট্রের আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন ৷ তিনি ধর্মশ্রয়ী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুস্পষ্ট উদ্যোগ নেন ৷ মধ্যযুগের ভারত ইতিহাসের ঔরঙ্গজেব ব্যক্তিগত ধর্মনীতির দ্বারা তার রাষ্ট্র ব্যবস্থা কতটা প্রভাবিত হয়েছিল তা বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের সূচনা করেছেন ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
ঔরঙ্গজেবের ঈশ্বর ছিলেন একমাত্র আল্লাহ ৷ তিনি বিশ্বাস করতেন ইসলাম এবং একমাত্র ইসলামের মধ্যেই প্রকৃত সত্য নিহিত আছে ৷ ইসলামের রক্ষক ঔরঙ্গজেব এক নির্দেশনামা জারি করেন, তিনি কোরান বিরোধী বিভিন্ন প্রথা বন্ধ করে দেন ৷ তিনি নওরোজ, ঝরোখা,দর্শন প্রভৃতি নীতি বন্ধ করে দেন ৷ এমনকি জন্মদিনের সম্রাটকে ধনরত্ন দ্বারা অভিনন্দন এর যে রীতি চালু ছিল তাও তিনি বন্ধ করে দেন ৷ সিদ্দিচাষ,জুয়া খেলা,মদ্যপান ইত্যাদি বন্ধের ব্যবস্থাও করেন ৷ মুসলমানরা যাতে যথারীতি নামাজ পড়ে রমজানের উপবাস পালন করেন তা দেখার জন্য সরকারি কর্মচারী নিয়োগ করেন ৷ এমনকি দোলযাত্রার সময় রাজপথে হৈ-হুল্লর,গান ও মহরমের মিছিল বন্ধ করে দেয় ৷
অবশ্য সম্রাটের কঠোর নির্দেশ সত্বেও এই আদেশের অনেকগুলি অকার্যকর থেকে গিয়েছিল ৷ হিন্দুদের উপর আক্রমণ ও মন্দির ধ্বংসের এই নীতি ঔরঙ্গজেবের পিতার আমল থেকেই লক্ষ্য করা যায় ৷ ওরঙ্গজেব তার রাজত্বের প্রথম বছরে বেরোনসের ব্রাহ্মণকে এক ফরমানে স্বীকার করিয়েছিলেন যে পবিত্র ইসলামের আইন অনুসারে প্রাচীনের মন্দিরের ওপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না, তবে কোন নতুন মন্দিরের অনুমতি দেওয়া যাবে না ৷
১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে এক আদেশ জারি করে পৌত্তলিকদের সমস্ত শিক্ষালয় ও ধর্ম প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দেন ৷ ওই বছরেই বেনারসের বিশ্বনাথ মন্দির ধুলিস্যাৎ করা হয় এবং পরের বছরের সূচনাতেই মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয় বিখ্যাত কেশব রায়ের মন্দির ৷ শুধু মন্দির ধ্বংস করা হয়নি সেই ধ্বংস স্তুপ এর ওপর গড়ে তোলা হয়েছিল এক বিশাল মসজিদ ৷ ঐতিহাসিক এলিয়ট বলেছেন এই মন্দিরের মূর্তিগুলি প্রতিধ্বংসকারীদের এই আচরণ ও পরিণতি সম্পর্কে যে বিবরণ দিয়েছে তা ওরঙ্গজেবের অত্যন্ত চূড়ান্ত ধর্মীয় অনুধরতা এবং গোড়ামির পরিচয় ৷ ১৭৭৯ থেকে ৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় 280 টি মন্দির ধ্বংস করা হয় ৷
ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতি আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল জিজিয়া কর এর পুনর প্রবর্তন ৷ এই কর প্রবর্তনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের সম্প্রসারণ এবং পৌত্তলিকদের দমন ৷ জিজিয়া কর অমুসলমান দের কাছ থেকে আদায় করা হতো এতে সব থেকে বেশি ক্ষতিকর হয়েছিল নিম্ন আয় ভুক্ত সাধারণ অমুসলিম৷ কাফি খা লিখেছেন," এই করের বিরুদ্ধে অমুসলমানদের মধ্যে দুঃখ ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল ৷"
সম্প্রতি কোন ঐতিহাসিক ও লেখক আওরঙ্গজেব এর ধর্ম ও হিন্দু-নীতির স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন ৷ এদের যুক্তি হল ঔরঙ্গজেব ব্যক্তিগত স্বার্থে ধর্মনীতির স্থির করেনি ৷ তিনি চেয়েছিলেন কুরআন চেয়েছিল ঈশ্বরের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এবং ঈশ্বরের নির্দেশ ঈশ্বরের জীবদের বিচার ও শাসন করতে ৷ ড ঈশ্বরী প্রসাদ,যদুনাথ সরকার , শ্রীবাস্তব প্রমুখ ও ঐতিহাসিক মনে করেন যে ধর্মনেতা হিসাবে তিনি কোরানের নির্দেশ মেনে চলেন নি ৷ ডক্টর পান্ডে বলেছেন ঔরঙ্গজেব রাজনৈতিক কারণেই সমস্ত সব মন্দির ভেঙে দেন তেমনি মসজিদ ভেঙে দেন তাই মন্দির ভাঙ্গার কাজকে ধর্মীয় দিক থেকে বিচার না করে রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার করা উচিত ৷"
ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতির বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ হয় মথুরার জাট সম্প্রদায়ের দ্বারা ৷ এছাড়াও বুন্দেলখন্ডের জনগণ বিদ্রোহী হয় এমনকি সৎনামি গোষ্ঠীভুক্ত হিন্দুরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ৷ ঔরঙ্গজেবের প্রচন্ড অত্যাচার দ্বারা এই বিদ্রোহ দমন করেন ৷ শুধু তাই নয় ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতির বিরুদ্ধে শিখ সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ ঘোষণা করে ৷
ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতির স্বপক্ষে উপস্থাপিত যুক্তিগুলোর যথার্থ স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় যে তার নীতি রাষ্ট্রের স্বার্থে সহায়ক হয়নি । একটি বহু জাতি ধর্ম সমন্বিত রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ওপর সংখ্যালঘিষ্ঠের ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া কখনোই সুফল দায়ক ছিল না । এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র লিখেছেন," ঔরঙ্গজেব মনে রাখেন নি যে সপ্তদশ শতাব্দী ভারতীয় পরিস্থিতির মতো চতুর্দশ বা পঞ্চদশ শতাব্দীর মত ছিল না ।" বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীকে দমন করার জন্য তাকে ছুটতে হয়েছিল দেশের এই প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ৷ ঔরঙ্গজেবের মতো প্রতিভাবান প্রশাসকের অদূরদৃষ্টিকতার আচরণ সত্যিই বিস্ময়ের ৷ তবে এই কথা বললে অযৌক্তিক হবে না যে ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্ত ধর্মনীতি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পথকে ত্বরান্বিত করেছিল ৷
সম্ভাব্য প্রশ্নঃ -
(১). ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতি ব্যাখ্যা করো
(২). ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় নীতি কতটা রাজনৈতিক বিবেচনা প্রসূত ছিল