ইবন বতুতার রেহলাকে কি মধ্যযুগের ভারত ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলা যায়? বা ,ইবন বতুতার 'রেহালা' গ্রন্থকে কী আদি মধ্যযুগের ইতিহাসের উপাদান বলা যায়?

ভারত ইতিহাসের উপাদান হিসেবে বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। সু প্রাচীনকাল থেকে বহু জ্ঞানী গুণী মানুষ ভারত ভূমিতে উপস্থিত হয়েছেন এই সংস্কৃতির পীঠ ভূমির দুর্বার টানে। ইতিহাসগত উপাদানের ভরপুর অতি নির্ভরযোগ্য একটি ভ্রমণ বৃত্তান্ত হলো ইবন বতুতার 'কিতাব-ই-রেহালা'।
হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে গজনী ও কাবুল হয়ে ১৩৩৩ সালে ইবন বতুতা ভারতে প্রবেশ করেন। তখন দিল্লির সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক তাকে কাজী হিসেবে নিয়োগ করেন। ব্যক্তিগতভাবে সুলতানের সঙ্গে মেলামেশার ফলে মহম্মদ-বিন-তুঘলকের চরিত্র ও কৃতিত্ব সম্পর্কে তিনি 'রেহালা' গ্রন্থে যথেষ্ট আলোকপাত করেছেন। K.M. Asraf- এর মতে, ইবন বতুতা প্রত্যক্ষ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করেই বিভিন্ন
ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। তার মেলামেশার পরিধি যেমন ছিল ব্যাপক তেমনি আন্তরিকতাও ছিল গভীর। সুতরাং, তার দেওয়া বিবরণ হিন্দুস্তানের তৎকালীন জীবনের এক জীবন্ত ছবি। ইবনে বতুতার বিবরণে আমরা বাংলার রাজনৈতিক অবস্থার বর্ণনা পাই। তিনি তখনকার বাংলার সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহকে একজন খ্যাতিমান নরপতি হিসেবে প্রশংসা করেছেন যিনি বহিরাগতদের বিশেষত ফকির ও সুফি দরবেশদের পছন্দ করতেন। ইবনে বতুতা সোনারগাঁয়ের সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ও লক্ষ্ণৌতির সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহের মধ্যকার তীব্র সংঘর্ষের স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরেছেন।
ইবনে বতুতার বিবরণ থেকে বাংলায় দাসপ্রথার প্রচলনের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর সাক্ষ্যমতে তখন খোলাবাজারে দাস দাসী বেচাকেনা হতো। এছাড়া তার বর্ণনায় তৎকালীন বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ পাওয়া যায়। দেশে খাদ্যশস্যের প্রাচুর্য এবং দৈনন্দিন ব্যবহার্য পণ্যের সস্তা দর উল্লেখ করে তিনি বলেছেন যে, পণ্যের এমন প্রাচুর্য ও সস্তা দর তিনি পৃথিবীর আর কোথাও দেখেননি। তিনি দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসার প্রসার এবং বাংলার অধিবাসীদের বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কেও বর্ণনা দিয়েছেন। তবে তিনি বাংলার অতিরিক্ত বর্ষন ও স্যাঁতসেতে আবহাওয়ার সমালোচনা করেছেন।
ইবন বতুতা তার 'রেহালা' গ্রন্থে বলেছেন যে, তার দেওয়া বিবরণে এমন কিছু ঘটনা আছে যা, সাধারণের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য মনে হবে। কিন্তু তিনি দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন এই গ্রন্থের বিবরণী সম্পূর্ণ সত্য। এই দাবির যৌক্তিকতা পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। কারণ তিনি ছিলেন
স্বাধীনচেতা সম্পন্ন পর্যটক। ভারতীয় শাসকদের গুনাগ্রহের প্রতি তার যেমন লোভ ছিল না তেমনি রাজনৈতিক নিগ্রহকে তিনি ভয়ও করতেন না। যদিও কিছু ঐতিহাসিকগণ তার গ্রন্থের বিবরণীকে কিছুটা নৈর্বক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যক্ত করেছেন। তা সত্ত্বেও ইবন বতুতার 'রেহালা' গ্রন্থকে আদি মধ্যযুগের ইতিহাসের এক অমূল্য দলিল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।