ক্যান্টন বাণিজ্য বলতে কী বোঝ? ক্যান্টন বাণিজ্যের বৈশিষ্টগুলি আলোচনা করো?কেন এই বাণিজ্যের অবসান ঘটলো?
প্রাক আধুনিক চীনা রাষ্ট্রে পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গে চীনাদের কোনো বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল না বললেই চলে । কিন্তু, নানকিং সন্ধির আগে পর্যন্ত গোটা চীন বিদেশীদের কাছে রুদ্ধ থাকলেও একমাত্র ক্যান্টন ছিল বিদেশীদের কাছের উন্মুক্ত বন্দর ৷ চিনা আদালত ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে এক নির্দেশ নামার দ্বারা একমাত্র ক্যান্টন বন্দরকেই বিদেশিদের বাণিজ্যের জন্য খুলে দেয় ৷ এইভাবে ক্যান্টন বন্দরকে কেন্দ্র করে চিনে বিদেশিদের এক বন্দর কেন্দ্রিক যে বাণিজ্যিক প্রথার সূচনা হয় তাকেই ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথা বলা হয় ৷ এই প্রথা ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দ নানকিং সন্ধি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগে পর্যন্ত টিকে ছিল । ফেয়ার ব্যাঙ্ক বলেছেন যে ক্যান্টন বাণিজ্য একটি পৃথক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল।" ইয়েন-পিঙ্গহাও তার "The Commercial Revolution in the 19th century china" গন্থে সাম্প্রতিক গবেষণার ভিত্তিতে দেখিয়েছেন, "ক্যান্টন বন্দরটি চীনের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত ছিল ৷ চীনের কোয়াং টু প্রদেশে অবস্থিত এই বন্দরটির উত্তর দিকে অবস্থিত ছিল ৩টি বন্দর নিংপো, অ্যাময়, সাংহাই এবং ক্যান্টনের দক্ষিণে অবস্থিত ছিল ম্যাকাও ৷ কিন্তু ক্যান্টন ছাড়া অন্য কোনো বন্দরে পাশ্চাত্যের বনিকদের কোনো যোগাযোগ ছিল না । ক্যান্টন বন্দর কর্তৃপক্ষ বিদেশীদের ওপর অনেক বানিজ্য শর্ত আরোপ করেছিলেন ৷ তাই অনান্য বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে ক্যান্টন বন্দরে একটি বিশেষ পার্থক্য ছিল । ক্যান্টন বাণিজ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, -
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
প্রথমতঃ - চীনের ক্যান্টন বন্দরে বিদেশিরা বাণিজ্য করার সুবিধা- লাভ করলেও স্থায়ী ভাবে বসবাসের অনুমতি পেত না । গ্রীষ্মকালে বাণিজ্য বন্ধ থাকার সময় তারা ম্যাকাও বন্দরে আশ্রয় গ্রহন করত । শুধু তাই নয় বাণিজ্য বারার অধিকার পেলেও ক্যান্টনের আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যাপারে তারা মেলামেশার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল ৷
দ্বিতীয়তঃ বিদেশি বণিকরা চীনের ক্যান্টন বন্দরী এসে স্বাধীনভাবে বা সরাসরি এখানকার বাণিজ্য অংশ নিতে পারত না কেননা বিদেশে বণিকদের কোন অবস্থাতেই চীনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। বা অন্য কোন বণিকদের কাছ থেকে সস্তা দরেও তাদের মাল কেনার কোন অধিকার ছিল না । চীনা সরকার একমাত্র কুলহং নামক বণিক সংঘ কেই একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার দিয়েছিল এবং বিদেশি বণিকরা ক্যান্টন বন্ধরে একমাত্র হক বণিকদের কাছ থেকে মাল কিনতে বাধ্য ছিল । কোহং এর সদস্যদের বলা হত হয় হং-বণিক ৷ কোহং সংগঠক গভর্নর জেনারেল এবং ক্যান্টনের আবগাড়ি অধিকর্তাদের কাছে দায়বদ্ধ ছিল । এই আফগাড়ি অধিকর্তাদের বলা হত হোপ্পো । এই হোপ্পেরা ছিলেন অতন্ত্য দুর্নীতি গ্রস্থ ৷ হং বণিকদের কাছ থেকে এরা প্রচুর পরিমাণে অর্থ আদায় করতেন । হং বনিকরা প্রথমে ১২টি পরে ২৩টি বাণিজ্যিক কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিল।
তৃতীয়তঃ - কো হুং বনিক সংস্থার অধিনা হং বনিকরা ছিল ৩ শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল ৷ ইমানুয়েল সু এই ৩ শ্রেণীর বনিবাদের কথা উল্লেখ করছেন (১). চাউ-ফুং-হং যারা ফুজিয়েনের ব্যবসায় দক্ষ ছিল (২).পেং - কাং - হং যারা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ব্যবসায় দক্ষ ছিলেন ৷ (৩). ওয়াই- ইয়াং-হং ইউরোপীয় এবং আমেরিকার বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্ত ছিলেন ।
চতুর্থতঃ প্যান্টনের একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার পেয়ে কো-হং বণিকরা অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে । ঐতিহাসিক জাঁ শোনো লিখেছে যে,"ক্যাটনে হং বনিকেরা এক ধরনের অভিজাত্য গড়ে তুলেছিল ৷ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্যান্টন বন্দর আমেরিকা, ফ্রান্স, হল্যান্ড, সুইডেন, বেলজিয়াম, বিট্রেন ও ডেনমার্ক- এর বনিকদেরই প্রাধান্য দিতেন । কো হং সংগঠন অকদিকে যেমন বিদেশী বনিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন অপর দিকে চীনের ভাইসরয়, ম্যাজিস্টেট, গভর্নরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন ৷ কো-হং সংগঠন ছাড়া বিদেশী বনিকদের সরাসরি সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারত না ৷ বাণিজ্যের বেশিরভাগ লাভ বংশই কো-হং বণিকরা আত্মসাৎ করে নিত ।
পঞ্চমতঃ – চীনারা নিজেদের সভ্যতা সংস্কৃতি সম্পর্কে উচ্চ ধারনা প্রসন করত । বিদেশীদের চীনারা অসভ্য বর্বর, সামুদ্রিক দানব বলে অভিহিত করত । তারা মনে করত বিদেশীদের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য করার কোনো প্রয়োজন ৷ সেই কারণে ক্যান্টন বন্দরের বাইরে বিদেশী বনিকরা তাবু খাটিয়ে বানিজ্যের জন্য সাময়িক ভাবে বসবাস করত । মূল ভূ-খন্ডে প্রবেশের কোনো অধিকার তাদের ছিল না ।
ষষ্ঠত: – চিনা সম্রাট ভয় করতেন, বিদেশী বণিকদের ধর্ম ও সংস্কৃতি চিনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করলে চিনের সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে পড়বে । এই কারণে ব্যবসা বাণিজ্য করার সময় বিদেশ বনিকদের চিনা সম্রাটের বিধি নিষেধ গুলো মেনে চলতে হত ।
সপ্তমত: -ক্যান্টন বাণিজ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর পাক্ষীকতা (একপক্ষী) চিনের জনগন ক্যান্টন বন্দর থেকে কোনো বিদেশী পন্য আয় করত । কিন্তু ইউরোপীয়রা বিপদের ঝুঁকি নিয়েও এই বাণিজ্য করত তার কারণ চীনের চা, চিনি, চীনামাটির বাসনপত্র ও Silk-rute[ কাঁচামাল ] এবং রেশম ছিল তাদের কাছে আবশ্যিক । জ্যাঁ শোনো তাই লিখেছেন যে – 'এভাবে ক্যান্টন বাণিজ্যের মাধ্যমে চীনারা বিদেশী বনিকদের নিয়ন্ত্রনে রেখেছিল। ৷
অষ্টমতঃ – কোন বিদেশী দুধ বানিজ্যের উদ্দেশ্যে চিহ্ন সম্রাটের সাক্ষাৎপ্রার্থী হলে প্রথমে তাকে চীনা সম্রাটের প্রতিবস্যতা স্বীকার ের নিদর্শন স্বরূপ উপার্খন দিতে হতো এটি নজরানা পদ্ধতি নামে পরিচিত। । তা ছাড়া অর্থ বাণিজ্যের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল "কাউতাও প্রথা' এই প্রথায় যে যেকোনো বিদেশি দুধ বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে চীনা সম্রাটের সাক্ষাৎপ্রার্থী হলে তাকে প্রথম চীনা সম্রাটের প্রতিবছতা শিকারের নিদর্শন রূপ সম্রাটের সামনে ভূমি পর্যন্ত নত হতে, একই কাও তাও প্রথা বলা হয়। । চীনে বাণিজ্য করতে গেলে বিদেশী বর্ণিকদের এই প্রথা মেনে চলতে হবে বাধ্যতামূলক । এই তুই কোথায় ইউরোপীয়দের অত্যন্ত খারাপ লেগেছিল ৷
নবমত : কিন্তু পরবর্তীকালে আফিম ববসা বৃদ্ধি পেলে ক্যান্টন বাণিজ্যের ভারসাম্য ইংরেজদের অনুকূলে চলে যায় । প্রথম দিকে বিদেশী বণিকরা বাধ্য হয়েই ক্যান্টন বাণিজ্যের শর্তাবলী মেনে চলত কিন্তু আফিম ব্যবসা ক্ষেত্রে তারা ক্যান্টন বাণিজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করলে এই প্রথার অবসান ঘটে । অর্থাৎ প্রথম আফিম যুদ্ধে চিনের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ক্যান্টন বানিজ্যের অবসান ঘটে ।
ক্যান্টন বানিজ্যের অবসান
ক্যান্টন বন্দর ছিল চিনে দক্ষিণ পূর্ব দিকে নিজ সভ্যতাও সংস্কৃতি সম্পর্কে চিন বিদেশীদের দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দিত না। ক্যান্টন বন্দরের মাধ্যমে বহিঃ বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখে, দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ক্যান্টন বানিজ্যে অবসান ঘটে । প্রথম আফিম যুদ্ধে চিনের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে বলাবাহুল্য এর পিছনে বিভিন্ন কারণ বিত্তমান ছিল। যেমন
(i). কাটন বানিজ্য লাভ জনক হলেভ বিদেশী বিশেষত ইংরেজ বনিকদের কাছে এটি ছিল অপমান জনক । কাত্ততাও এবং নজরানা প্রথার বিভিন্ন বিধিনিষেধ, চিনা আইন-এর বিচার তাদের ক্যান্টন ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলার জন্য প্ররোচিত করেছিল ।
(ii). চিনা ও বিদেশী বনিকরা প্রথম থেকেই পরস্পরের প্রতি বিরাগ ও মনোভাবাপণ্য ছিল । চিনারা বিদেশী বনিকদের অবাঞ্ছিত বলেই মনে করত । যেহেতু ইউরোপীয় বণিকেরা পণ্য ক্রয় করার জন্য বেশী আগ্রহী ছিল । তাই তারা মনে করত তাদের নির্ধারিত দাম শুল্ক ও শর্ত মেনেই বিদেশী বনিকদের ব্যবসা করতে হবে । বিদেশী ধনিকরা চিনাদের এই মনোভাবেই অসন্তুষ্ট ছিল ।
(ii) ১৭৮৪ খ্রিঃ ২৪ শে নভেম্বর এক বিশেষ অনুষ্ঠানে ইংরেজদের জাহাজে ৩ জন ম্যান্ডারিন মারা যায় । এর প্রতিক্রিয়া "চিনারা ক্যান্টনে বিশৃখলা সৃষ্টি করে এবং ইংরেজ গোলন্দাজকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয় । এই ঘটনা ইংরেজরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করে । ইংরেজ বনিকদের ক্যান্টন বানিজ্যে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে Company Bond of control এর সভাপতির পরামর্শে, জর্জ ম্যাকার্টনি মিশনকো - পিকিং-এ পাঠানো হয় । বাণিজ্যিক সম্পর্ককে কূটনৈতিক ভিত্তি প্রদান করতে রাজি হয় না ।
ক্যান্টন বানিজ্য বিট্রিশদের কাছে ছিল অত্যন্ত লাভ জনক কিন্তু উপরিউক্ত পরিস্থিতিতে East India Company ও বিট্রিশ সরকারের ৩টি পথ খোলা ছিল যথা (i) ক্যান্টন বন্দর, (ii). বন্দর কেন্দ্রিক বাণিজ্য পরিত্যাগ করা, চিনা সম্রাটের আরোপিত বিধি নিষেধ মেনে চলা(iii). যুদ্ধের মাধ্যমে অবস্থার পরিবর্তন করা ।
ক্যান্টন বাণিজ্য ছিল ব্রিটিশদের কাছে অত্যন্ত লাভজনক বাণিজ্য ছিল ৷ তাই তারা কোনো কারণেই এই বাণিজ্য পথকে হারাতে চেয়েছিল না এবং তাদের বিরুদ্ধে সমস্ত অপমানের বদলা তারা নিতে চেয়েছিলেন ৷ এই সকল সমাধানের একটি মাত্রই পথ ছিল যুদ্ধ এবং তারা এই পথটিকে বেছে নেয় ৷ সংঘটিত হয় প্রথম আফিমের যুদ্ধ ৷ প্রথম আফিমের যুদ্ধে চীনের পরাজয় হলে রুদ্ধদ্বার চীন বিদেশি বণিকদের কাছে মুক্ত হয় এবং ক্যান্টন বাণিজ্যের অবসান ঘটে ৷