চীনের একশত দিবসের সংস্কারের ব্যর্থতা ও তাৎপর্য আলোচনা কর
চীনের একশত দিবসের সংস্কারের ব্যর্থতা ও তাৎপর্য আলোচনা কর
একশত দিবসের সংস্কার আন্দোলনের ব্যর্থতা আলোচনা করতে গিয়ে জনৈক্য আধুনিক ঐতিহাসিক জ্যাক গ্রে বলেছেন,"একশত দিবস ব্যর্থ হয়েছিল কারণ, চীনের জনগণও তখন ছিল অসংগঠিত অস্পষ্ট, যদি রক্ষণশীলদের দমননীতির স্বীকার হবার ফলে সংস্কারপন্থী নেতারা জনসাধারণের সহানুভূতি লাভ করেছিলেন ৷" তথাপি এই সংস্কার আন্দোলন সমাজের অভ্যন্তরে অন্তত সীমিত সমর্থন লাভ করেছিল ৷ এছাড়াও সংস্কারপন্থীরা চীনের কৃষির গুরুত্বের সম্মুখ উপলব্ধি করতে পারেনি ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
তারা তাদের কর্মসূচিতে কৃষির উন্নতির প্রতি চূড়ান্ত অবহেলা প্রদর্শন করেছিলেন ৷ কৃষকে অবহেলা করে কোনরকম সংস্কার সাধন করা সম্ভব ছিল না ৷ তদপরি সংস্কার আন্দোলনের প্রভাব চীনে বিদেশি অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে পারেনি । এর জন্য সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল একদিকে তারা বিদেশি অনুপ্রবেশের বিরোধিতা করে অপরদিকে তারা পাশ্চাত্য করনের নীতি গ্রহণ করেন ফলে সংস্কারপন্থীদের নীতির মধ্যে এক আপাতত অসংযত পরিলক্ষিত হয়েছিল ৷
জ্যা শোনা বলেছেন এই সংস্কার আন্দোলনের পিছনে জনসমর্থনের বিরাট অভাব ছিল বলেই সংস্কারপন্থীরা সম্রাটের উপর নির্ভর করে তাদের সংস্কার গুলি বলবৎ করতে চেয়েছিলেন ৷ অথচ সত্যি কারের সামাজিক ক্ষমতা নিহিত ছিল তাদের নিকৃষ্টতম শত্রুদের হাতে ৷ গনপ্রজাতন্ত্রী চীনের মার্কসবাদী ঐতিহাসিকেরা মন্তব্য করেছেন," চীনের সংস্কারপন্থীরা কখনোই আধা উপনিবেশিক এবং আধা সমাজতান্ত্রিক চীনের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আন্তরিক প্রয়াসী হয়নি । পূর্বতন ব্যবস্থাকে মোটামুটি অক্ষর রেখে তারা কিছু প্রগতিশীল সংস্কার প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন ৷ যে সময় চীনের সর্বস্তরে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসা উচিত ছিল সেই সময় সংস্কারপন্থীরা সংস্কারের চোরাবালিতে বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন ৷
তাই তাদের ব্যর্থতায় পর্যভূষিত হওয়া ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা ৷ তবে একথা অস্বীকার করা যায় না যে," সংস্কারপন্থীরা শিল্প বাণিজ্যের অগ্রগতিকে স্বাগত জানিয়েছিলও একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ভাবাদর্শের বন্ধনকে আঘাত করেছিল । সংস্কার আন্দোলনের ব্যর্থতার পরে একটি বৃহৎ গন বিদ্রোহ প্রায় সমগ্র চীনকে আচ্ছন্ন করেছিল ৷
শত দিবসের সংস্কার শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও ভবিষ্যৎ চীনের জন্য কিছু কিছু শিক্ষা রেখে গিয়েছিলেন ৷ সংস্কার প্রস্তাব গুলি বাতিল ঘোষিত হলেও মাঞ্জু দরবারে মধ্যপন্থী সংস্কার গুলি চলতে থাকে । 1898 খ্রিস্টাব্দের চেয়ে বড় তাৎপর্য হলো চরমপন্থীদের বিপ্লবাত্মক কর্মসূচির ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল ৷ সম্রাট কুয়াং-সু এবং কাং- ইউ-ওয়েই হয়ে ছিলেন চিনা সমাজের ওপর তলার বা অভিজত সমাজের প্রতিনিধি ৷ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ফলে সক্রিয় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে আসেনি ৷
সাধারণ জনগণের সঙ্গে তখন কৃষক সমাজের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না ৷ তাই সাধারণ জনগণ আন্তরিকতার সাথে সংস্কারগুলি কে গ্রহণ করেনি ৷ সাধারণ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ ধ্বনিত হলেও রক্ষণশীল গোষ্ঠী এ সত্ত্বেও সংস্কার পরিকল্পনা গুলি বাতিল ঘোষণা করতে পারবে না ৷ তাই ভবিষ্যতে বিপ্লবাত্মক সংস্কার পরিকল্পনাকে সার্থক রূপ দেওয়ার গণসংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূতি হয় । প্রয়োজন হলে তা হিংসাত্মক পথে আসতে হবে ৷ রক্ষণশীল গোষ্ঠী শাসন ক্ষমতা দখল করলেও যোগ্য নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয় । তাদের চরম ব্যর্থ তাকে ঢাকতে তারা দেশের জনগণকে বিদেশীদের বিরুদ্ধে উসকে দেয় ৷ তাদের স্লোগান হয়,"বিদেশিদের হাত থেকে বাঁচা, তাহলে সব অসুবিধা দূর হবে ৷"
এই ভাবেই তারা বক্সার আন্দোলনের পথ প্রস্তুত করে ৷ রক্ষণশীল মাঞ্চু দরবার চীনা বিরোধী নীতি মাঞ্চু ও চীন জাতির মধ্যে রুখে দাঁড়ায়, দূরত্ব বাড়াও ৷ প্রতিক্রিয়াশীল মহাসচিব কাং- ই বলেন সংস্কার চীনাদের উপকারী এসেছিলেন ৷ কিন্তু মাঞ্চুদের ক্ষতি করেছিল ৷ এর স্বাভাবিক ফল হিসাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ চীনা জাতির মনে এই বিষয়ে বিশ্বাস জন্মায় যে মাঞ্চুর রাজবংশের পতন ছাড়া তাদের মুক্তি নেই এবং এই মুক্তি আসবে সমাজের নিচের স্তর থেকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ৷ চিনা জনগণের এই বিশ্বাসকে বাস্তব রূপ দেওয়ার নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন ১৯১১ সালের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের সফল নেতা সান-ইয়াৎ-সেন ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
বুঝতে চাইলে ভিডিওটি দেখতে পারেনঃ
শতদিবস সংস্কারে তাৎপর্য বা গুরুত্ব?
ইতিহাসের কোন ঘটনা একতরফাভাবে বিচ্ছিন্ন নয়। শত দিবসের সংস্কারের প্রস্তাবগুলি কার্যকরী না হলেও চীনের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবনের উপর এগুলির প্রভাব উপেক্ষা করা যায় না। তৎকালীন আধা সামন্ততান্ত্রিক চিনে শত দিবসের সংস্কারপন্থীরা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগী হন এবং শিল্প ও বাণিজ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
প্রথমত, সম্রাট কোয়াংসু ও কাং এর ব্যর্থতা চীনের ভবিষ্যত বিপ্লবের সাফল্যের পথ প্রশস্ত করে। সম্রাট স্বয়ং এর উচ্চ পরিবারগত সুপন্ডিত কাং প্রবর্তিত সংস্কারের ব্যর্থতা একথা প্রমাণ করে যে সমাজের উচ্চ স্তরের নেতৃবৃন্দ কর্তৃকু কোন সংস্কার জনগণকে আন্তরিকতার সঙ্গে স্পর্শ করতে পারেনি। বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন বা সংস্কার সার্থক করতে গেলে সমাজের নিচের তলা করা উচিত-- এই শিক্ষা ভবিষ্যৎ চীনের ইতিহাসে কাঙ্খিত সাফল্য এনে দেয়।
দ্বিতীয়ত, রাজমাতা জসি ও তার রক্ষণশীল অনুচররা দেশকে সঠিক নেতৃত্ব দানের পরিবর্তে কেবলমাত্র বিদেশিদের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব পোষণ করতে দেশবাসীকে উৎসাহিত করায় বক্সার বিদ্রোহের মানসিক ভিত্তি ভূমি রচিত হয়।
তৃতীয়ত, মাঞ্চু দরবার চীনা বিরোধী নীতি অনুসরণ করলে এবং চীনা সংস্কারকদের শাস্তি দিলে মাঞ্চু ও চিনাদের মধ্যে বৈরীতা আরো প্রকট হয়ে ওঠে। চিনাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মনে করতে থাকেন মাঞ্চুদের পদচ্যুত করতে না পারলে চীনাদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল হবে না। মাঞ্চুবিরোধী এই মানসিকতা ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের বক্সার বিদ্রোহ এবং ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লবের পটভূমি রচনা করে।
চতুর্থত, এই আন্দোলনের ব্যর্থতা থেকে চীনারা এই শিক্ষা পেয়েছিল যে, মাঞ্চুদের পদচ্যুত করতে হলে সমাজের নিচের তলার নেতাদের অধীনে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অগ্রসর হতে হবে এরই ফলশ্রুতিতে ডক্টর সান ইয়াৎ সেন নেতা হিসেবে উঠে আসেন। তার নেতৃত্বের ফলশ্রুতিতে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে প্রজাতান্ত্রিব বিপ্লব ও মাঞ্চু রাজ বংশের পতন ঘটে। তাই বলা যায় আপাতো ব্যর্থতা সত্বেও চীনের ভবিষ্যৎ ইতিহাসে শত দিবসের সংস্কার এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়।