ইক্তা ব্যবস্থা বলতে কি বোঝো ? বা,ইক্তা ব্যবস্থা কি আলোচনা কর? ইক্তা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ও বিবর্তন আলোচনা কর? বা, দিল্লীর সুলতানদের আমলে ইক্তা প্রথার বিবর্তন অনুসন্ধান কর।
দিল্লির সুলতানি আমলে বার্ষিক শাসন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে ইলতুৎশিই প্রথম ইক্তা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন ৷ তার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের প্রাচীনকাল থেকে যে সামন্ত প্রথা চলে আসছিল তার বিলুপ্তি করা এবং কেন্দ্রীয় শাসনের সঙ্গে দূরবর্তী অঞ্চলের যোগসূত্র সুদৃঢ়ভাবে স্থাপন করা ৷ মহরাবাদি দুই ধরনের ইক্তা কথা বলেছেন যথা ইক্তা-ই-তাখসিক এবং ইক্তা-ই- ইস্ত্রিকালাল ৷ প্রথমত ইক্তা বলতে ভূমি রাজস্ব বোঝাত আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে শাসক কর্তৃক ব্যক্তি বিশেষ কে অর্থ মঞ্জুরীর বোঝানো হতো । প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রথমত ইক্তা ছিল গুরুত্বপূর্ণ ৷ ঐতিহাসিক ইরফান হাবিবের মতে উপলব্ধ রাজস্ব সম্পদ শাসক শ্রেণীর মধ্যে বন্টিত হতো সুলতান কর্তৃক নির্দিষ্ট অঞ্চলে এক একজনের রাজস্ব আদায় করার অধিকার সুলতান করতে প্রদান করার মাধ্যমে ৷ এইরকম শর্ত নিযুক্ত দুই তাগীয় একককে বলা হয় ইক্তা ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
সুলতানি আমলে প্রদেশ গুলি কেউ সামরিক অঞ্চলগুলিতে ইক্তা নামেও অভিহিত করা হয়েছিল ৷ আবার দুই ধরনের ছিল ছোট ও বড় ছোট ইক্তাগুলিকে কোন প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব পালন করতে হতো এবং আদাই কৃত রাজস্বের প্রশাসনিক খরচ বাদে উদ্বৃত্ত রাজস্ব কেন্দ্র কে পাঠাতে হতো ও ইক্তার আয় থেকে অধীনস্ত সেনাবাহিনীর ভরণপোষণ করতে হতো ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হতো ৷ প্রতিটি ইক্তার শাসক মুক্তি নামে সামরিক ছিলেন । যার অধিকার ছিল সুলতানদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করত ৷ ডক্টর শ্রীবাস্তব বলেছেন একটি পর্যায়ে মুক্তিগণ খুবই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তাই বলবনের পূর্বে সুলতানরা মুক্তিদের এই ইক্তা থেকে আর এক একটা বদলির ব্যবস্থা করেন ।
ইলতুৎমিস ব্যাপকভাবে তুর্কিদের মধ্যে ইক্তা বিতরণ করেছিলেন ৷ তবে তিনি মুক্তিদের দমন করতে যথেষ্ট সচেষ্ট হয়েছিলেন ৷ বলবোন ইক্তার মুক্তিদের নানা রকম দুর্নীতি দূর করার উদ্দেশ্যে সামরিক ব্যবস্থার মধ্যে সংস্কার সাধন করেছিলেন ৷ যারা শারীরিকভাবে উপযুক্ত ও সামরিক সাহায্যে করার অধিকার দেন ৷ আলাউদ্দিনের সময়ে সুলতানি সাম্রাজ্যের দাক্ষিণাত্যসহ চূড়ান্ত বিস্তার ঘটলে ইক্তা ব্যবস্থায় ইলতুৎমিস পরবর্তী রীতির পরিবর্তন ঘটে যায় । ফিরোজশাহ তুঘলক পূর্বের পদাধিকারী পুত্রদের সেই পদে নিয়োগের নীতি ঘোষণা করেন । এই ইক্তা ব্যবস্থা বংশানিক্রমিক তার চরিত্র নেয় ৷ লোদী আমলেও মোটামুটি একই ব্যবস্থা চলতে থাকে ৷
ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব ইক্তা ব্যবস্থার অর্থনৈতিক দিক বিশ্লেষণ করে তিনটি পর্যায়ে উল্লেখ করেছেন ৷ প্রথম শতাব্দীতে সাম্রাজ্যের গঠিত ছিল রাজস্ব সংগ্রাহক প্রশাসকদের দিয়ে তারপর, দ্বিতীয় পর্যায়ে চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাজস্ব আদাই ও ইক্তার আয় বৃদ্ধির জোর দেওয়া হয় । ইক্তাগুলির ওপর রাজকীয় চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হয় ৷ তৃতীয় পর্যায়ে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত ইক্তা ব্যবস্থার সরলতার আঁচ ফিরিয়ে আসে ৷ তবে একটা প্রসঙ্গ অবশ্যই থেকে যায় তা হল শর্ত নিয়োগের ও সরাসরি কৃষকদের উদ্বৃত্ত ভোগ দখল করতে থাকে ৷ এই প্রক্রিয়াতে কৃষক অতিরিক্ত শোষণের কবলে পড়েছিলেন ৷ তাই ইরফান হাবিবসহ অনেকেই এই ব্যবস্থাই কৃষকরা আধা ভূমিধসে পরিণত হয়েছিল বলে মনে করেন ৷
ইক্তা ব্যবস্থার ফলে সুলতানি আমলে এক নতুন শাসক শ্রেণীর আবির্ভাব যারা ছিলেন শহরে চরিত্রে তাদের প্রবল আগ্রহ ছিল ৷ সংগৃহীত রাজস্বের নগদ অর্থের রূপান্তরিত করার কাজে ভূমি রাজস্ব সিংহভাগই যেহেতু ছিল কৃষকদের উদ্বৃত্ত সুতরাং গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৃহদায়তন বাণিজ্য স্থাপিত হওয়ায় স্বাভাবিক ৷ আবার ইক্তাদের রাজত্ব হিসাবে কামিল উৎপন্নের এক মোটা অংশ শহরে যাবার ফলে জনবসতি বৃদ্ধি পায় ও হস্তশিল্প গড়ে ওঠে ৷ ওই দিক থেকে বিচার করলে বলা যায় সুলতানি আমলেই ইক্তা ব্যবস্থা মধ্যযুগীয় বাণিজ্যের বিকাশ ও নগরায়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ৷ তবে ইক্তা ব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবেই পূর্বতন শাসক শ্রেণীর সামাজিক মর্যাদা বেশ খানিকটা নামিয়ে দিয়েছিলেন ৷ তার উত্থান হয়নি কিন্তু বশীভূত হয়েছিল ৷
ইরফান হাবিবের মতে সুলতানি আমলে এই ব্যবস্থা কোন সামরিক বিপ্লব নয়,নতুন রূপ বলা যেতে পারে ৷ এই শোষণ ব্যবস্থা কে কেন্দ্র করে নাগরিক বরগাছা জীবনযাত্রা গড়ে উঠেছিল ৷ এই ব্যবস্থায় কৃষক আধা ভূমিধসে পরিণত হয়েছিল ৷ তবে ইক্তা ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হওয়ায় ফলে মুদ্রাবৃত্তি অর্থনীতির প্রচলন বৃদ্ধি পেয়েছিলেন ৷ রাজকীয় উদ্যোগে কারিগরি দক্ষতার উন্নতি সাধন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচার ও সর্বোপরি নগরায়নের পথ প্রস্তুত করেছিল ৷