ফিরোজ শাহ তুঘলকের জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি আলোচনা কর অথবা ফিরোজ শাহ তুঘলকে সুলতানি যুগের আকবর বলা কতটা যুক্তিযোগ্য বা,ফিরোজ শাহ তুঘলকের জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি সম্পর্কে আলোচনা কর।
তুঘলক বংশীয় অপুত্রক সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের মৃত্যু হলে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী সংক্রান্ত দ্বন্দ্বে সুলতানি সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে ৷ ক্রমতাবস্থায় কিছু আমির ওমরাহের অনুরোধ মহম্মদ বিন তুঘলকের খুল্লতাত পুত্র ফিরোজ শাহ তুঘলক অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিল্লির সুলতানি মনসদ অলংকৃত করেন ৷ তবে ফিরোজ শাহ তুঘলকের সিংহাসন আরোহন নিয়ে ঐতিহাসিক মহলের বিতর্ক আছে ৷ বারনির মতে ফিরোজ সুলতান পদে মহম্মদ বিন তুঘলক মনোনীত হয়েছিলেন ৷ স্যার উলজি ফিরোজ শাহকে জবরদস্তি দখলকারী সুলতান বলে অভিহিত করেছেন ৷ যাইহোক দীর্ঘ ৩৭ বছর তিনি দিল্লির সিংহাসন পরিচালনা করেন এই সময়ে তিনি একাধিক জনহিত কর কর্মসূচি গ্রহণ করেন ৷ তার ফলে ইতিহাস ইতিহাসে তিনি প্রজাহিতৈষী বা প্রজা কল্যাণকর শাসক হিসেবে পরিচিত হয়ে আছেন ।
ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজত্বকাল সম্পর্কে জানার জন্য আমরা যে সকল ঐতিহাসিক গ্রন্থ গুলির ওপর নির্ভর করে থাকি তার মধ্যে অন্যতম হলো ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরণী রচিত "তারিখ-ই-ফিরোজশাহী" ঐতিহাসিক শামসি-ই-সিরাজ আফিফ রচিত "তারিক-ই- ফিরোজশাহী" স্বয়ং সুলতান আত্মজীবনী "ফুতুহ-ই -ফিরোজশাহী" এবং "ফুতুহ-ই-জাহান্দারী" এছাড়া যে সকল ঐতিহাসিকের রচনা এই যুগে ইতিহাস পাঠকদের নিকট মুহূর্ত করে তুলেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলো ঐতিহাসিক নিজামী,ঈশ্বরী প্রসাদ, শ্রীবাস্তব, এলফিনস্টোন, এলিয়ট প্রমুখ ৷
সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের একাধিক পরিকল্পনা গুলির মধ্যে অন্যতম হলো জনসাধারণের আর্থিক উন্নয়নের সংগৃহীত পরিকল্পনা গুলি ৷ ভারত যেহেতু কৃষি প্রধান দেশ তাই কৃষির উন্নয়নের একাধিক খাল খনন করেন ৷ পুরাতন খাল সংস্কার করেন গভীর নলকূপ স্থাপন করেন ৷ তিনি পাঁচটি অতি গুরুত্বপূর্ণ খাল খনন করেন ৷ দেড়শ মাইল দীর্ঘ একটি খাল কেটে যমুনা থেকে হিসার জল আনা হয় ৷ এছাড়াও ঘর্ঘরা থেকে ফিরোজাবাদ,যমুনা থেকে ফিরোজাবাদ খালকাটা হয় ।
ফিরোজ শাহ তুঘলকের জনহিত কর কার্যবলির মধ্যে অন্যতম ছিল কর ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ৷ শরীয়তের বিধান অনুসারে কেবলমাত্র চার প্রকার কর চালু করেন যথা খারজ বা ভূমি রাজস্ব,খামোশ বা লুণ্ঠিত দ্রব্য বা খনিজ দব্যের এক পঞ্চমাংশ, যাকাত হল মুসলমানদের দেওয়া সম্পত্তির কর এবং জিজিয়া হল অমুসলমানদের উপর আরোহিত এক প্রকার ধর্ম কর ৷
সুনির্মাতা হিসেবেও ফিরোজ শাহ তুঘলক কর্ম কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন না ৷ ফেরিস্তার মতে ফিরোজ ৫০ টি বাঁধ, ৪০টি মসজিদ,৩০ কলেজ ,২০ প্রাসাদ,১০০ টি সরাইখানা,২০০ টি শহর, ৩০ টি জলাধার,১০০ টি চিকিৎসালয়,৫টি সমাধি সৌধ, ১০০টি স্নানাগার,১৫০টি সেতুসহ অসংখ্য বাগিচা, বিনোদনগৃহ ইত্যাদি নির্মাণ করে ৷ ফিরোজ শাহ নির্মিত শহর গুলির মধ্যে অন্যতম হলো ফিরোজাবাদ ফতেয়াবাদ,হিসার,জৌনপুর, ফিরোজপুর ইত্যাদি ৷ আফিফ রচনায় ফিরোজাবাদ শহরের বিশালতা ও বই বৈভরের ভুয়োসী প্রশংসা করেছেন ৷ ঐতিহাসিক উলজি হেগ নির্মাতা হিসাবে ফিরোজ শাহের দক্ষতা ও কৃতিত্বকে রোমান সম্রাট অগাস্টারের সাথে তুলনা করেছেন ৷
জনহিত কর শাসক হিসেবে ফিরোজ শাহ তুঘলকের ন্যায় শাসক ইতিহাসে খুবই বিরল ৷ জনগণের স্বার্থে বিশেষত দরিদ্র জনগণের জন্য একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন ৷ দার-উল-সিফা অর্থাৎ দরিদ্র মানুষদের জন্য দাতব্য চিকিৎালয়,দেওয়ান-ই-খয়রাত অর্থাৎ কন্যাদায়গ্রস্থ পিতাদের সাহায্য করার জন্য বিশেষ অর্থ দান করার ব্যবস্থা,"দেওয়ান-ই হস্তিহক" অর্থাৎ যার সাহায্যে যোগ্য ও বিদ্বান ব্যক্তিদের সাহায্য করার ব্যবস্থা করেন । ডক্টর রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে ফিরোজ কোমল ও কৃতজ্ঞতা পূর্ণ মানসিকতার মানুষ ছিলেন ৷
ফিরোজ শাহ তুঘলকের একাধিক জনহিতকর কর্মসূচি দিয়ে লক্ষ্য রেখে ঐতিহাসিক হেনরি এলিয়ট, এলফিনস্টোন প্রমুখরা সুলতানি যুগের আকবর বলে অভিহিত করেছেন ৷ অপরদিকে বেঞ্চান্স স্মিথ ও ডক্টর শর্মা ঈশ্বরী প্রসাদ প্রমুখরা সুলতানি যুগের আকবর বলার পক্ষপাতী নয় ৷ ঐতিহাসিক আসিফ সুলতানকে একজন আদর্শবাদী প্রজা কল্যাণকর শাসক বলে উল্লেখ করেছেন ৷ তবে ভিনসেন্ট স্মিথ সুলতান কে আকবর বলার বিরোধিতা করে বলেন,"আকবর বিশ্বের দরবারে নিজের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জনকল্যাণের পাশাপাশি তার উচ্চ ধর্ম নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কিন্তু এই মহান ধর্ম নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠায় ফিরোজ ব্যর্থ ৷" এদের মধ্যে আকবর একটি গভীর তথ্য সহজে উপলব্ধি করেছিলেন যে সকল ধর্মের মূল বাণী এক কিন্তু ফিরোজ শাহ তুঘলকের ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতা দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়নি ৷
উপরইক্ত সমালোচনা স্বীকার করে নিয়ে এ কথা বলা যেতে পারে যে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক একজন জনকল্যাণকর শাসক ছিলেন কৃষির উন্নয়ন সেচের উন্নয়ন,কর ব্যবস্থার সরলীকরণ শুল্ক ব্যবস্থা রোহিতকরণ,শিল্প-সাহিত্য পৃষ্ঠপোষকরণ সাংস্কৃতিক জগতে প্রতি দায়বদ্ধতা সর্বোপরি দরিদ্র জনগণের সেবায় একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মধ্যে দিয়ে সুলতান যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন তা ধর্ম,বর্ণ সম্প্রদায়নিবেশের সকলের কাছে মঙ্গলময় হয়ে ওঠে ৷
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ফিরোজ শাহ তুঘলকের জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি আলোচনা কর অথবা ফিরোজ শাহ তুঘলকে সুলতানি যুগের আকবর বলা কতটা যুক্তিযোগ্য এই নোটটি পড়ার জন্য