আলাউদ্দিন খলজি মূল্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ন্ত্রণ নীতি কেন এবং কিভাবে প্রবর্তন করেছিল অথবা,তুমি কি মনে কর সামরিক প্রয়োজন নয়, জনগণের কল্যাণই আলাউদ্দিন খলজীকে বাজারদর নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়নে উৎসাহিত করেছিল? বা,আলাউদ্দিন খলজির বাজার নিয়ন্ত্রণনীতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
ভারতের সুদীর্ঘ ৩২০ বছরের সুলতানি সাম্রাজ্যের খলজি শাসক আলাউদ্দিন খলজি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে ৷ সুলতান আলাউদ্দিন খলজী কৈশর অবস্থা থেকে দু চোখ জুড়ে বহন করতেন দিকবিজয়ী গ্রিক আলেকজান্ডার হওয়ার স্বপ্ন ৷ তাই তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারের কলপে ৪ লক্ষ ৭৫ হাজার সৈন্য সংগ্রহ করে ৷ কিন্তু ইতিহাসে আলাউদ্দিনের পরিচয় কেবল যুদ্ধ ও পররাষ্ট্র জয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় ইতিহাসে আলাউদ্দিন লাভ করেছেন তার জনকল্যাণকর অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে ৷
আলাউদ্দিন খলজির মূল্য নিয়ন্ত্রক পরিকল্পনা ও সংস্কার সম্পর্কে জানতে আমাদের যে সকল ঐতিহাসিক গ্রন্থের উপর নির্ভর করতে হয় তা হয় জিয়াউদ্দিন বারুনীর "তারিক-ই-ফিরোজশাহী" এবং "কুতুহ-ই-জাহান্দারি" আমির খসরুর "খাজাইন-উল-ফুতুহ" সুফি সান্ত নাসির উদ্দিন চিরাগের "খায়ের-উল-মুজলিস" এবং "ফেরিস্তার বিবরণ এ বিষয়ে বিশেষ আলোচনা পাওয়া যায় । তবে বরনির বিবরণী এক্ষেত্রে আমাদের প্রধান উপাদান হিসেবে সাহায্য করে ৷
আলাউদ্দিন খলজির মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা রাজার নিয়ন্ত্রণ নীতি দুটি মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে ৷ (১). রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার (২). বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ৷ এছাড়াও তিনি উচ্চপদস্থ অভিজাতকদের সকল সম্পত্তি রাষ্ট্রয়াত্ব করেন ৷ লাহোর থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত জমি জরিপ করে এবং ওই অঞ্চলের সমস্ত গ্রামগুলিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। মধ্যস্বত্ব ভোগীদের ক্ষমতা ধ্বংস করেন ইক্তা ব্যবস্থার নবায়ন ঘটিয়ে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন ৷ ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব তার "ক্যামব্রিজ ইকোনমিক হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া" নামক গ্রন্থে বলেছেন যে," আলাউদ্দিন প্রবর্তিত অর্থনীতির মধ্যে দিয়ে কৃষকদের উপর চলে আসার শোষণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ৷"
আলাউদ্দিন যথার্থ উপলব্ধি করেছিলেন যে রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস ছিল কৃষি অর্থনীতি ৷ তাই আলাউদ্দিন খলজী রাষ্ট্রের অর্থনীতির শ্রীবৃদ্ধি কল্পে ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধি করেন ৷ আলাউদ্দিনের পূর্বে ভূমি রাজস্বের হার ছিল ১/৬, আলাউদ্দিন তা বাড়িয়ে ১/২ এর ফলে রাষ্ট্রের অর্থ ভান্ডার ব্যাপক বৃদ্ধি পায় ৷
আলাউদ্দিন খলজির জনগণের সুবিধার্থে চার প্রকার বাজার স্থাপন করেন যথা -(১).শস্যের কেন্দ্রীয় বাজার বা মান্ডি (২). বস্ত্র চিনি ওষুধ জ্বালানি ইত্যাদির জন্য সেরা-ই-আদল (৩). ঘোরা ক্রীতদাস গবাদি পশু ইত্যাদির জন্য আরেক ধরনের বাজার (৪). অন্যান্য জিনিসের জন্য একটি সাধারণ বাজার।
আলাউদ্দিন খলজি যে অর্থনৈতিক পরিচালনাটির ঐতিহাসিক মহলে সর্বাপেক্ষা বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তা হল তার বাজারদর নিয়ন্ত্রণ নীতি বা মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি ৷ আসলে দক্ষিণ ভারতের দ্বার সমুদ্র তেলেঙ্গানা কৈশল রাজ্য পাণ্ডু রাজ্য থেকে প্রচুর সম্পদ দিল্লিতে আসার ফলে মুদ্দাস্ফীতি বৃদ্ধি পায় ৷ এছাড়া রাজস্ব বিধি জনিত কারণে জনগণের উপর আর্থিক চাপ তৈরি হয় । আর এই সকল সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য আলাউদ্দিন অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নির্ধারণ করেন ৷ প্রতিটি দোকানে দ্রব্যমূল্যের তালিকা রাখার ব্যবস্থা করেন ৷ নির্ধারিত মূল্য থেকে অতিরিক্ত মূল্য নিলে কঠোর শাস্তি ব্যবস্থা করা হয় ৷ ফেরিস্তা এবং নাসির উদ্দিন চিরাগ দিল্লির জনগণের স্বাচ্ছন্দের জন্য এই মূল্য নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন বলে অভিমত পোষণ করেন ৷
আলাউদ্দিন খলজি তার মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি কে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত করার জন্য একাধিক আইন প্রণয়ন করেন ৷ ঐতিহাসিক বরণী যে সকল আইনের কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলি হল (১). কেউ প্রয়োজনের অতিরিক্ত দ্রব্য ক্রয় করতে পারবেনা (২). প্রতিটি জিনিসের সরকার নির্ধারিত মূল্য তালিকা সামনে টাঙিয়ে দিয়ে রাখতে হবে (৩). লাইসেন্স বা অনুমিত পত্র ছাড়া কেউ কৃষকের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করতে পারবে না (৪). কোন দোকানদার যদি দ্রব্য কম দেয় তাহলে তার শরীর থেকে সমপরিমাণ মাংস কেটে নেয়া হবে।
আলাউদ্দিনের বাজার নিয়ন্ত্রণ বা মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির উদ্দেশ্য ও প্রয়োগ ক্ষেত্র নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে নানান বিতর্ক আছে ৷ বরনি বলেছেন এটি কেবল দিল্লিতে বলবত ছিল ৷ ডক্টর সতীশ চন্দ্র বলেছেন তথ্যের অভাবে এ বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলা সম্ভব নয় ৷ অধ্যাপক শরণ এর মতে,"আলাউদ্দিন বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থা ছিল অযৌক্তিক এবং অর্থনীতির নিয়ম বহির্ভূত একটি প্রয়াস সুলতানদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে বল প্রয়োগ কার্যকরী করা ৷"ডক্টর লাল মনে করেন,"বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ফলে সাধারণ ক্রেতা উপকৃত হয়নি তাই এই ব্যবস্থাকে আলাউদ্দিনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ে " বস্তুত আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কঠোর ছিল এবং ত্রুটিমুক্ত ছিল না কিন্তু মৌলিক ব্যবস্থা হিসাবে অনস্বীকার্য সম্ভবত ৷ অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র এ বিষয়ে যথার্থ বলেছেন হিন্দু ও মুসলমান উভয় শ্রেণীর বণিকরা হয়তো এই নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সচার ছিল ৷ কিন্তু কেবল সেনাবাহিনী নয় সকল শ্রেণীর নাগরিক খাদ্যশস্য ও অন্যান্য সস্তা মূল্যের জন্য উপকৃত হয়েছিলেন ৷