প্রাচীন তথা আদিম মানুষ কীভাবে খাদ্য সংগ্রাহক থেকে খাদ্য উৎপাদকে পরিণত হয়েছিল সে সম্পর্কে আলোচনা করো।
প্রাচীন ও ভারতীয় সভ্যতার উষালগ্ন থেকে আধুনিক মানুষে উত্তরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপামান সহযোগী ভূমিকা পালন করেছিল। আর এক্ষেত্রে যে উপাদানটি এই দীর্ঘ বিবর্তনের সর্বক্ষেত্রে মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান রসদ ছিল, সেটি হল খাদ্য বা খাবার। প্রাচীন মানুষ যেমন একদিনে আধুনিক মানুষে পরিণত হয়নি তেমনই প্রাচীন মানুষ একদিনে খাদ্য উৎপাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেনি। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্তের মধ্য দিয়ে মানুষ খাদ্য সংগ্রাহক থেকে আজকের খাদ্য উৎপাদকে উপনীত হয়েছে। আর এক্ষেত্রে আমাদের আলোচ্য বিষয় হল প্রাচীন মানুষ কেমন করে খাদ্য সংগ্রাহক থেকে খাদ্য উৎপাদকে পরিণত হল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য প্রাচীন প্রস্তর যুগে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ছিল খাদ্য সংগ্রাহক। তারা আধাবরের মতো ঘুরে বেড়িয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে ফলমূল ও পশুর খাদ্য সংগ্রহ করে আনতো। তাদের খাদ্যের তালিকায় বড়ো বড়ো পশুর মাংস জায়গা করে নেয়। মাছ, কাছপ ও ঢিল তাদের খাদ্য-তালিকাভুক্ত। যে কারণে ওইযুগের মানুষের দেহে কোনো কার্বোহাইড্রেট ছিল না, ছিল শুধুমাত্র প্রোটিন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওই যুগের মানুষ অনুভব করেছিল যে শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ করে বেশিদিন কাটানো সম্ভব নয় কারণ। যে-কোনো সময় খাদ্যের সংকট দেখা দিতে পারে। ফলত তারা বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েকটি এলে ভাগ হয়ে খাদ্যের সন্ধান শুরু করলো, আর তাদের এই চিন্তার প্রতিফলন ঘটলো মধ্যপ্রস্তর যুগে গিয়ে।
মধ্যপ্রস্তর যুগে গিয়ে মানুষ প্রথম কিছু পশুকে পালন করতে শিখলো। এই যুগে মানুষ আগুনের ব্যবহার খুব ভালোভাবে রপ্ত করতে পেরেছিল, যার ফলস্বরূপ তারা মাংস পুড়িয়ে খেত যা তাদের চোয়ালকে সুগঠিত করার মধ্য দিয়ে তাদের শারীরিক পরিবর্তনে সাহায্য করে। এই পর্বেও মানুষ খাদ্য সংগ্রাহক ছিল। কিন্তু এই পর্বের মধ্য দিয়ে নব্য প্রস্তর যুগে প্রবেশ করার ফলে মানুষের জীবন জীবিকায় এক আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। এই প্রথম মানুষ পশুপালনের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু শস্য উৎপাদন করতে শিখলো, বার সহযোগী উপাদান হিসেবে এই যুগের হাতিয়ারগুলি আরও ধারালো ও ছোটো হতে শুরু করলো, কারণ এই পর্বে এসে মানুষ উপলব্ধি করেছিল যে খাদ্যভাণ্ডার বাড়াতে গেলে মাটিতে শস্য বীজ বপন করতে হবে।
ভারতের কোন্ অঞ্চলে প্রথম কৃষকের জন্ম হয়েছিল তা জানা না গেলেও সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ অব্দ নাগাদ ভারতে কৃষিকাজের সূচনা হয়েছিল বলা যায়। সর্বাপেক্ষা প্রাচীন শস্য হিসেবে যবের নাম পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে মেহেরগড়ে প্রথম কার্পাস চাষের নিদর্শন পাওয়া যায়। এই যুগের মানুষ উদ্বৃত্ত শস্য উৎপাদনের দিকে ঝুঁকেছিল। ফলে উদ্বৃত্ত শস্য মজুত করে রাখা হত অসময়ের জন্য। মেহেরগড়ের প্রথম পর্যায়ে বেশ কিছু বড়ো কামরাযুক্ত ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। সেগুলি সম্ভবত শস্যভান্ডার হিসেবে ব্যবহৃত হত। মেহেরগড়ের তৃতীয় পর্যায়ে গমের তুলনায় যবের উৎপাদন বেশি ছিল, যার ফলস্বরূপ শস্যাগারের আয়তন ও সংখ্যাও বেড়েছিল। আবার সেই উৎপাদিত শস্য বাড়িতে সংগ্রহ করে রাখার জন্য তৈরি করা হত বিভিন্ন আকারের মাটির পাত্র। মাটির পাত্রগুলি প্রথমে হাতে তৈরি হলেও পরবর্তী ক্ষেত্রে চাহিদার ওপর ভিত্তি করে কুমোরের চাকায় মৃৎপাত্র প্রস্তুত হতো এবং সেগুলি আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করা হত।
নব্যপ্রস্তর যুগে খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতির সূত্রপাতের ফলে খাদ্যের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা কাটিয়ে মানুষ স্থায়ীভাবে জমির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কীত হয়ে পড়ে
জমির অর্থনৈতিক মূল্য মানুষ উপলব্ধি করে যা ব্যক্তি সম্পত্তির উদ্ভবের প্রেরণা জোগায়। মানুষ কৃষির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার ফলে স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রয়োজন দেখা দিল এবং মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বপ্রথম গ্রামীণ সমাজের উদ্ভব ঘটে। নব্যপ্রস্তর যুগে মিশ্রচাষ অর্থনীতির ফলস্বরূপ কারুশিল্পের আবির্ভাব ঘটে। আর এইসব কিছুর মধ্য দিয়ে মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রায় এক আমূল পরিবর্তন বা বদল ঘটেছিল যা ঐতিহাসিক গর্ডন চাইল্ড-এর মতে ছিল নব্যপ্রস্তর বিপ্লব বা বিবর্তন।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, প্রাচীন মানুষ যে খাদ্য সংগ্রাহক থেকে খাদ্য উৎপাদকে উপনীত হয়েছিল সেটি পূর্ববর্তী দুটি পর্বের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। প্রাচীন প্রস্তর যুগে যেটার পথ পরিক্রমা শুরু হয়েছিল, নব্যপ্রস্তর যুগে গিয়ে সেটি বিকশিত রূপ লাভ করেছিল। সুতরাং, এই পর্যায়ে গিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা এক অন্যমাত্রা লাভ করেছিল। যার মধ্যে দিয়ে সেই যুগের মানুষের সামগ্রিক জীবানে অনেকটা পরিবর্তন ঘটেছিল।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ প্রাচীন তথা আদিম মানুষ কীভাবে খাদ্য সংগ্রাহক থেকে খাদ্য উৎপাদকে পরিণত হয়েছিল সে সম্পর্কে আলোচনা করো। এই নোটটি পড়ার জন্য