ভারত শাসন আইন সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা, 1930 খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন বাংলার উপর কি প্রভাব ফেলেছিল

1930 খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন বাংলার উপর কি প্রভাব ফেলেছিল
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন বা মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেননি ৷ এই কারণে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতব্যাপী গণ আন্দোলন শুরু হয় । সাধারণ মানুষ,শ্রমিক ও কৃষকদের যোগদানে এই আন্দোলন প্রবল রূপ ধারণ করে ৷ দেশে বিপ্লববধি কার্যকলাপ ও বৃদ্ধি পায় ৷ ভারতবাসীর কর্মকর্তা প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে সরকার দেশবাসীকে নতুন একটি শাসন সংস্কার গঠনের কথা ঘোষিত হয় । দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর 1930 খ্রিস্টাব্দে মে মাসে সাইমন কমিশন তার রিপোর্ট পেশ করে , এই রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯৩০,৩১ও ৩২ খ্রিস্টাব্দে পরপর তিনটি গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৷ তিনটি গোল টেবিল বৈঠকের আলোচনা ও প্রস্তাব গুলির ভিত্তিতে ব্রিটিশ সরকার একটি সুপারিশ পত্র পেশ করেন যেখানে ভারতের সংবিধান সংস্কারের জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয় ।
এই প্রস্তাব বিচার বিবেচনা করে নতুন শাসন সংস্কার প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে লর্ড লিনলিথগোর সভাপতিত্বে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কিছু মনোনীত সদস্যদের নিয়ে একটি যৌথ সিলেক্ট কমিশন গঠিত হয় । দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর 1934 খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর কমিটির রিপোর্ট প্রেস করেন এই রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত সচিব স্যামুয়েল এর নেতৃত্বে "হাউস অফ কমেন্সের" বিল উপস্থাপন করা হয় ৷ বিলটিকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রবল বিতর্ক চলে ৷ শেষ পর্যন্ত ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২রা আগস্ট বিলটি আইনে পরিণত হয় ৷ ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন ৷ এই আইনে বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় সেগুলি হল
- কেন্দ্রে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় ৷
- প্রদেশ গুলিতে স্বায়ত্য শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা
- হয় ৷
- সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলির জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয় ৷
- ব্রিটিশ ভারতীয় প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে কেন্দ্রে একটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের ব্যবস্থা করা হয় ৷ দেশীয় রাজ্যগুলির পক্ষে এই যুক্তরাষ্ট্র গঠনের ব্যবস্থা করা হয় দেশীয় রাজ্যগুলির পক্ষে এই যুক্তরাষ্ট্রের যোগদান করা সম্পূর্ণ তাদের ইচ্ছাধীন ছিল।
- সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখার উদ্দেশ্য কেন্দ্রে গভর্নর জেনারেল প্রদেশ গুলি গভর্নরের হাতে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়
১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন অনুসারে কেন্দ্রে এক ধরনের দৈত্য শাসন ব্যবস্থা স্থির হয় যে,
যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার গভর্নর জেনারেলের এক মন্ত্রিসভার ওপর দেয়া থাকে ৷ আইনসভায় সদস্যদের মধ্যে থেকে গভর্নর জেনারেল তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিযুক্ত করবে ৷
কেন্দ্রে একটি দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে নিম্নকক্ষের সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৭৫ জন এবং উচ্চ কক্ষের সদস্যদের সংখ্যা ছিল ২৫০ জন ৷
কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন ক্ষমতা সংরক্ষিত এবং হস্তান্তরিত নামে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয় । সংরক্ষিত বিষয় অর্থাৎ দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি, অভ্যন্তরীণ আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, মুদ্রাস্ফীতি এবং ধর্ম সংক্রান্ত বিষয় পরিচালনার দায়িত্ব কখনো জেনারেল এর উপর দেওয়া হয় ৷
সংরক্ষিত ক্ষমতার বাইরে শিক্ষা স্বাস্থ্য প্রভৃতি বিষয় নিয়ে হস্তান্তরিত ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত হয় ৷ মন্ত্রিসভা পরামর্শ ক্রমে গভর্নর জেনারেল এই সব বিষয়ে পরিচালনার করবেন । তবে মন্ত্রীদের পরামর্শ গ্রহণ করা বা না করা সম্পূর্ণ তা স্বেচ্ছাধীন ছিল ৷
গভর্নর জেনারেল তার কাজের জন্য ভারত সচিব ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকবে ৷
এই আইনের বলে কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বন্টনের জন্য তিনটি তালিকা প্রকাশ করা হয় (১). কেন্দ্র তালিকা (২). প্রাদেশিক তালিকা ও (৩). তিন যুগ্ম তালিকা ৷
নতুন এই আইন অনুসারে
- ব্রহ্মদেশকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং উড়িষ্যা ও সিন্দকে দুটি পৃথক করেছে পরিণত করা হয় ৷
- উপদেশগুলোতে দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বায়ত্ব শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত করা হয় ৷
- গভর্নরের হাতে প্রদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকে ৷
- গভর্নর কে সাহায্য করার জন্য একটি মন্ত্রীসভা থাকবে এবং এদের সদস্যরা প্রাদেশিক আইন সভার সদস্যদের মধ্য থেকে গভর্নর কর্তৃক নিযুক্ত হবে ৷ মন্ত্রীরা তাদের কাজের জন্য আইন সবার কাছে দায়বদ্ধ থাকবে ৷
- পাদেশিক আইনগুলির এক কক্ষ বা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট হতে পারত ৷
- মুসলিম সদস্যদের জন্য পৃথক নির্বাচনে ব্যবস্থা করা হয়
- গভর্নর বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিল তার হাতে আইন প্রবর্তন প্রণয়ন বাতিল করার অধিকার ছিল ৷
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন ভারতের কোন রাজনৈতিক দলকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি ৷ মুসলিম লীগ এই আইনকে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার ধ্বংসস্ত্রী বলে অভিহিত করে বলে যে এই আইন দ্বারা মুসলিম সমাজ ও অন্যান্য ভারতীয় জনগণের মতো এই সমান ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৷ " মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতে,"এই আইন ছিল পচ্চনশীল এবং সম্পূর্ণভাবে আইন অগ্রহণযোগ্য ৷" জহরলাল নেহেরু একে," দাসত্বের নতুন দলিল বলে অভিহিত করেন ৷" নরমপন্থী নেতা মদনমোহন মালব্য বলেন যে," বাইরে থেকে দেখলে আইনটি গণতান্ত্রিক বলে মনে হয় কিন্তু ভেতরের তা হলো চরম শূন্য ৷" জাতীয় কংগ্রেসের মত এই আইন ছিল সম্পূর্ণ হতাশা ব্যাঞ্জক ৷" বিপান চন্দ্র বলেন যে ,"এই নতুন আইন ভারতের জাতীয়তাবাদী মানুষের প্রত্যাশা মোটেই পূরণ করতে পারেননি ৷" কারন এই আইনের সমস্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব ব্রিটিশদের হাতে থেকে গিয়েছিল ৷ একমাত্র সুবিধা যা দেওয়া হয়েছিল তা হলো এই যে জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত কয়েকজন মন্ত্রী কে ভারতে ব্রিটিশ প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অংশ নেওয়ার সুযোগ ৷
ভারতীয় জনমতকে সম্পন্ন অগ্রাহ্য করে এই আইন নানা ত্রুটি ছিল ৷ ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের নয় এক এর মূল লক্ষ্য ছিল ভারতের ক্রমবর্ধমান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কোন আন্দোলনকে দুর্বল করে দিয়ে ভারতের ব্রিটিশ সরকারের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা ৷ সাম্রাজ্যবাদীর চার্চিল ও লিনলিথগো বক্তব্যের এই মত স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে ৷ এই আইনে বলা হয় যে দেশীয় রাজ্যগুলির অর্ধাংশ কেন্দ্র যোগ দিলেই তবে যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে ৷ কিন্তু দেশীয় রাজ্যগুলির এতে যোগদান করেননি ৷ এই ব্যবস্থায় ভারতীয় প্রদেশগুলোকে কেন্দ্রে এবং কেন্দ্রে কে ব্রিটিশ রাজ্যের প্রতিনিধি গভর্ণর জেনারেলের অধীনে আনা হয় । এমনকি এই আইনে দেশবাসীকে ক্ষমতা প্রদান করার অপেক্ষা ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের আধিপত্যই পরিলক্ষিত হয় ৷ তাই জহরলাল নেহেরু একে ,"একটি মেশিনের সঙ্গে তুলনা করেছেন যার ইঞ্জিন নেই কিন্তু ব্রেক খুবই শক্তিশালী ৷"
নানা ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার সত্বেও ভারতের শাসনতান্ত্রিক ক্রমবিকাশের ইতিহাসে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইনের গুরুত্ব অপরিসীম ৷ এই আইন স্বাধীন ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় দায়িত্ব শাসনব্যবস্থার বৃদ্ধি রচনা করে ৷ এই আইনে যুক্তরাষ্ট্রীয় অংশ বাস্তবায়িত না হলেও প্রাদেশিক স্বার্থ শাসনের নীতি কার্যকর হয় । এর ফলে প্রদেশ গুলিতে দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, পরবর্তীকালে এই আইনটির ওপর ভিত্তি করে ভারতীয় সংবিধান গড়ে ওঠে ৷
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ভারত শাসন আইন সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা, 1930 খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন বাংলার উপর কি প্রভাব ফেলেছিল এই নোটটি পড়ার জন্য