গিয়াসউদ্দিন বলবন কিভাবে দিল্লি সুলতানিকে সুসংহত করেছিলেন? অথবা,গিয়াসউদ্দিন বলবন কী কী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন? তিনি সেগুলি কতদূর সমাধান করতে পেরেছিলেন?
দিল্লি সালতানাতের ইতিহাসে গিয়াসউদ্দিন বলবনের শাসনকাল এক গৌরোবজ্জ্বল স্থান অধিকার করে আছে (১২৬৬-৮৭)। গিয়াসউদ্দিন বলবন ছিলেন দিল্লি সুলতানির একমাত্র শাসক যিনি সবিস্তারে রাজতন্ত্র সম্পর্কিত মতবাদ গড়ে তুলেছিলেন। বীরত্ব ও কর্মদক্ষতায় প্রভুর সন্তুষ্টি বিধান করে নাসিরুদ্দিনের রাজত্বকালে গিয়াসউদ্দিন বলবন চহেলগামী বা চল্লিশজনের গোষ্ঠীভুক্ত আমীরগনের নেতা হিসেবে দরবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হযেছিলেন।
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
গিয়াসউদ্দিন বলবনের সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের এক সুদৃঢ় কেন্দ্রীয় শাসনের যুগ শুরু হয়। কিন্তু ইলতুৎমিসের দুর্বল উত্তরাধিকারী এবং মোঙ্গলদের ধারাবাহিক আক্রমণ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তাকে চরমভাবে বিঘ্নিত করে। এই অবস্থায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে রাজতন্ত্রের মর্যাদা ও শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বলবন সাম্রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন।
বলবন প্রথমেই রাজতন্ত্রের মর্যাদা ও শক্তিবৃদ্ধির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলেন যে, গর্বিত তুর্কি আমিরগণের ক্ষমতা বিনষ্ট না করা পর্যন্ত রাজকীয় মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ঐতিহাসিক বারানি বলেছেন যে, নাসিরউদ্দিনের শাসনকালের শেষদিকে রাজার কোনো মর্যাদাই ছিল না। এমনকি জনসাধারণ রাজাকে সম্মানও দিত না,ভয়ও করত না। তাই তিনি এও বুঝেছিলেন, রাজশক্তিকে দৃঢ়রূপে সংস্থাপিত করতে হলে, সুগঠিত সেনাবাহিনী অত্যাবশ্যক।
দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় তিনি উপলব্ধি করেন যে, ক্ষমতালিপ্স ওমরাহদের চক্রান্তই কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার প্রধান কারণ। স্বৈরতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী বলবন মনে করতেন যে, কেবলমাত্র চরম স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমেই প্রজাদের আনুগত্য আদায় ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব। ওমরাহদের শক্তি খর্ব করে রাজশক্তির মর্যাদা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি দু'টি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন - (১) নতুন রাজকীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও (২) ‘চল্লিশ চক্র’ এর উচ্ছেদ সাধন। রাজপদকে মহিমান্বিত করে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি ঘোষণা করেন যে, সুলতান ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তিনি জনসাধারণ বা ওমরাহদের ইচ্ছায় সিংহাসনে বসেননি। ঈশ্বর- আদিষ্ট পুরুষ হিসেবে তাঁর কাজকর্মের সমালোচনা করার অধিকার মর্ত্যালোকে কারোর নেই। গিয়াসউদ্দিন পারসিক দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে দরবারে তিনি নানা নতুন নিয়মকানুন যথা, ‘সিজদা' ও ‘পাইবস' রীতি প্রবর্তন করেন । যার অর্থ ছিল সিংহাসন ও সম্রাটের কাছে নতজানু হওয়া।
ইলতুৎমিসের আমল থেকে গড়ে ওঠা ‘বন্দেগান-ই-চিহালগানি’ বা ‘চল্লিশ চক্র' বা ওমরাহদের ক্ষমত ও মর্যাদা খর্ব করার উদ্দেশ্যে তিনি নানা কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। কর্তব্য কর্মে অবহেলা বা তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে তিনি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনচক্ষে তাঁদের হেয় করে তুলতেন। প্রয়োজনে তাঁদের বিষপ্রয়োগে হত্যা করতেও তিনি কুণ্ঠিত হতেন না। বলাবাহুল্য, তাঁর নিজের এবং নিজ উত্তরাধিকারীদের সিংহাসনের সকল সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের অপসারণ ও সিংহাসনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্যই তিনি এই সব কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করেন।
সাম্রাজ্যের সকল সংবাদ সংগ্রহের জন্য গিয়াসউদ্দিন বহু ‘গুপ্তচর' বা ‘বারিদ' নিযুক্ত করেন। কেবলমাত্র সৎ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদেরই তিনি একাজে নিযুক্ত করতেন। গুপ্তচরেরা কোনো সংবাদ দিতে ব্যর্থ হলে তিনি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। বলাবাহুল্য, এই গুপ্তচররাই ছিল তাঁর স্বেচ্ছাতন্ত্রের প্রধান হাতিয়ার। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাজশক্তির প্রধান ভিত্তি হল সেনাবাহিনী। এজন্য তিনি নতুনভাবে সেনা-সংগঠন, শৃঙ্খলা রক্ষা ও সেনাবাহিনীকে শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা করেন।
সুলতানী যুগের একজন উল্লেখযোগ্য শাসক হিসেবে ভারত ইতিহাসে গিয়াসউদ্দিন বলবন এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। বিজেতা হিসেবে নয়-সংগঠক হিসেবেই ইতিহাসে তিনি স্মরণীয়। সুলতানী যুগের এক সংকটময় মুহূর্তে শাসনের গুরুদায়িত্ব নিয়ে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, স্বার্থান্ধ ওমরাহদের দমন, মোঙ্গল আক্রমণ নিবারণ, সেনাদল সংগঠন, গুপ্তচর বাহিনী গঠন এবং রাজকীয় মর্যাদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে সুলতানি সাম্রাজ্যকে তিনি কেবলমাত্র ধ্বংসের হাত থেকেই রক্ষা করেননি পরবর্তীকালে তার বিস্তৃতির পথকেও তিনি সুগম করে দেন।