জাতীয় কংগ্রেসের কার্যাবলী আলোচনা কর
ইংরেজ আমলে ভারতের বিভিন্ন অংশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাঝারি আকারে বিদ্রোহ সংঘটিত হলেও তা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারেননি । এর কারণ হিসাবে বিদ্রোহীদের মধ্যে বোঝাপড়া ও সচেতনার অভাব ছিল ৷ আন্দোলনের পদ্ধতি ও রূপরেখা একই রকম ছিল না ৷ ফলে উনিশ শতকের স্বাধীনতা সংগ্রাম বলতে অনেক নারাজ ৷ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা ভারতের রাজনৈতিক জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে । কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার দুই শতকের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠান ভারতের রাজনৈতিক জীবনে বটবৃক্ষের ন্যায় একটি প্রধান জাতীয়তাবাদী সংস্থায়ী পরিণত হয় ৷ এই কংগ্রেসকে কেন্দ্র করেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আবর্তিত হতে থাকে ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দতে জাতীয় কংগ্রেসের পর থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কুড়ি বছর সময় কালকে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগ বলে অভিহিত করা হয় ৷ এই পর্বে বিভিন্ন মানুষ সমবেত হয়েছিল ফলে আদর্শ ও তথ্যের সংঘাতের নরমপন্থী,চরমপন্থী socialist প্রভৃতি নানা মতবাদের উদ্ভব হয়েছিল ৷ কিন্তু কেউ কংগ্রেসের মূল পর্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি ৷ প্রথম পর্বে কংগ্রেসের নেতাদের লক্ষ্য ছিল ইংরেজ শাসনের অধীনে স্বায়ত্তশাসন লাভ করা ৷ তারা ইংরেজদের শাসনকে ঐশ্বরিক অবদান বলে মনে করত। পাশাপাশি বলতেন এখন ইংরেজদের সাথে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সময় নয় কারণ দেশ ও জাতি এখন গঠনের পথে ৷ সুরেন্দ্রনাথের ভাষায় "A nation in the making" এই উদ্দেশ্য তারা বিভিন্ন সভা সমিতি গঠন করেন ৷ বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন প্রকাশ এবং বাৎসরিক সম্মেলন গুলিতে গৃহীত প্রস্তাবের মাধ্যমে নানা প্রকার দাবি দাওয়া উপস্থাপন করা হয় ।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতৃবৃন্দ মনে প্রানে বিশ্বাস করতেন যে ব্রিটিশ শাসন হল ভারতের পক্ষে সবচেয়ে মঙ্গলজনক ৷ তারা মনে করতেন সঠিক পথে ভারতবাসীর দাবি-দাওয়ায় ইংরেজদের কাছে তুলে ধরতে পারলে সুবিচার পাওয়া যাবে ৷ এই সময়ে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ আবেদন নিবেদনের মাধ্যমে তাদের দাবি ইংরেজ সরকারের নিকট পেশ করতে থাকে এই জন্য জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্বের নেতারা নরমপন্থী নেতা নামে পরিচিত ৷ কংগ্রেসের মূল লক্ষ্য ছিল (১).সর্বভারতীয় গঠন রূপে নেতৃত্ব প্রদান (২). রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার দ্বারা জনগণকে শিক্ষিত করে তোলা (৩). গণতান্ত্রিক পথে একটি জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলা (৪). শাসনতান্ত্রিক সংস্কার ৷
কংগ্রেসের নেতাদের লক্ষ্য ছিল সর্বভারতীয় আন্দোলন পরিচালনা করা ৷ তাদের দাবি-দাওয়া গুলিকে মোট তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায় । প্রথমতঃ রাজনৈতিক , দ্বিতীয়তঃ প্রশাসনিক, তৃতীয়তঃ অর্থনৈতিক ৷
কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ নিজেদের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা ভারতীয়দের অধিকতর অংশগ্রহণের দাবি পেশ করে তাদের অন্যান্য দাবি গুলি ছিল বড়লাট ও প্রাদেশিক গভর্নরের শাসন পরিষদের যথাক্রমে দুইজন ও একজন ভারতীয় সদস্য গ্রহণ করা, নির্বাচনের মাধ্যমে সদস্য গ্রহণ, ভারতীয় শাসন, দেশীয় প্রতিনিধিদের আরো ক্ষমতা দান প্রভৃতি ৷ ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার জাতীয় কংগ্রেসের চাপে "ভারতীয় কাউন্সিল আইন" পাস করে ৷ প্রশাসনের উচ্চপদে নিয়োগ এবং বেতন বৃদ্ধির দাবিকে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত করেন ৷
প্রশাসনিক সংস্কারের ক্ষেত্রে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কংগ্রেসের দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল (১). সরকারি পদের অধিকাংশে ভারতীয়দের নিয়োগ করতে হবে ৷ (২). প্রশাসনিক বিভাগ থেকে বিচারবিভাগ বিথীকরণ (৩). পুলিশ প্রশাসনের সংস্কার (৪). ভারতীয়দের অস্ত্রবহনের অধিকার প্রদান (৫). সিভিল সার্ভিসের ভারতীয় পরীক্ষার্থীদের জন্য বয়সসীমা ১৯ থেকে বাড়িয়ে ২২ করা (৬). আয় কর পরিমাণ হ্রাস প্রভৃতি ৷ কেবলমাত্র উচ্চবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের স্বার্থ ভারতীয় কর্মচারীদের নিয়োগের দাবি করেছিল তা নয় ৷ বিদেশি কর্মচারীদের বেতন অবসর কালীন ভ্রাতা প্রভৃতি কারণে প্রচুর পরিমাণে অর্থ ভারত থেকে নিষ্কাশিত হতো তা বন্ধ করতে এই দাবি পেশ করা হয় ৷
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি কিভাবে ভারতের হস্তশিল্প ধ্বংস করেছে শিল্প বিপ্লবের পথ বন্ধ করেছে এবং ভারতে অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে তার রক্ষার জন্য কংগ্রেস কিছু অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবি পেশ করেন ৷ যেমন (১). ভারতে দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষের কারণ অনুসন্ধানের জন্য তদন্ত করতে হবে ৷ (২). অবাধ বাণিজ্য নীতি রোধ করে ভারতীয় শিল্প সংরক্ষণের কথা বলা হয় (৩). শুল্ক ব্যবস্থার বৈষম্য দূর ও ভারতের শিল্পের প্রসারের জন্য দাবি জানানো হয় ৷ (৪). প্রশাসনিক ও সামরিক হাতে খরচ কম করতে হবে ৷ (৫). ভারতীয়দের যে সমস্ত আয়কর লবণ কর নেওয়া হয় তা প্রত্যাহার করা (৬). ভারতে আধুনিক শিল্পের ফলাফল বিকাশ সাধন (৭). ভারতের কৃষকদের ওপর নির্ধারিত ভূমি রাজস্বের পরিমাণ হ্রাস করা প্রভৃতি ৷ পরবর্তীতে অর্থনৈতিক সংস্কার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে প্রধান হাতিয়ারের পরিণত হয়েছিল ৷
কংগ্রেসের কর্মসূচি কেবলমাত্র ধনী শিল্পপতি বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না । পাশাপাশি তারা সাধারণ মানুষের কথা ও ভেবেছিলেন তারা নরমপন্থী কংগ্রেসের নেতাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে যতটা সমালোচনা করা হয়েছিল তার থেকেও বেশি আলোচনা করা হয়েছিল ৷ তাদের আন্দোলনের পদ্ধতি নিয়ে ব্রিটিশ জাতির প্রতি উদারতা ও সহানুভূতির জন্য তারা কখনোই সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়নি ৷ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতৃবৃন্দের কার্যকলাপকে অনেকে রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি বলে অভিহিত করেছেন অশ্বিনীকুমার দত্ত কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন কে তিন দিনের তামাশা বলে অভিহিত করেছেন ৷ এই সকল কারণেই ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের সুরাট অধিবেশনের পর ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দুটি দলে (নরমপন্থী ও চরমপন্থী) বিভক্ত হয়ে পড়ে ৷