মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ উল্লেখ করো।
প্রাচীন ভারতের সর্বপ্রথম একচ্ছত্র আধিপত্যের অধিকারী বিশাল মৌর্য সাহায্য কালের নিয়াতে খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী ছিল না (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৩২৪ থেকে ১৮৭ খ্রিস্টপূণীদ)। সম্রকট অশোকের মৃত্যুর মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে মৌর্য সাম্রাজ্যের উজ্জ্বল শিখা জগতে তাঁপতে একেবারে নিভে গেল। ঐতিহাসিকরা এই সুবিশাল মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য একাধিক কারণকে দায়ী করেছেন। এগুলি নীচে আলোচনা করা হল- মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অশোকের বন্ধনীতিকে দায়ী করেছেন । এই নীতি গ্রহণের ফলে ব্রাম্মণদের সামাজিক শ্রেষ্ঠাং দূর হয়েছিল । ফলে রাজন সম্প্রদায় পুষ্যামিত্রের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল । অধ্যাপক শাস্ত্রী তাঁর বস্তুাব্যের সমর্থনে কয়েকটি যুক্তির অবতারণা করেছেন, এগুলি হল-
- এই অহিসো নীতি গ্রহণের ফলে পশুবলি নিযিল হয়েছিল। ফলে বজ্ঞানুষ্ঠানে বাধার সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে রাহুণদের জীবিকায় আঘাত পড়েছিল তাই এই নির্দেশকে ব্রাহ্মণরা সুনজরে দেখেননি।
- অশ্যেক বৌদ্ধধর্মকে অতিরিন্ত প্রাধান্য দিয়ে তাকে রাষ্ট্র ধর্মের মর্যাদা দিয়েছিল।
- ধর্মমহামাত্র নামক একশ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ করে তিনি ব্রাহ্মণদের অধিকার ও ক্ষমতা হ্রাস করেন।
- বিচারের ক্ষেত্রে রাহুনরা যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত দপ্তসমতা ও ব্যবহার সমতা নীতি প্রয়োগ করে অশোক তাদের এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেন। ফলে তাঁরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে
অধ্যাপক রায়চৌধুরী দেখিয়েছেন যে, অশোকের 'অহিংসা নীতি' তাঁর সামরিক শস্তিকে একেবারে দুর্বল করে দিয়েছিল। দীর্ঘদিন যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার ফলে সৈন্যবাহিনীর শক্তি ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছিল। ফলে তাঁর মৃত্যুর পরে যখন ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে গ্রিক বা মৌর্য সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করল তখন অযোধ্যা, পান্দাল, মথুরা পাটলিপুত্রের মতো নগরগুলি গ্রিকদের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হল। মৌর্য সামরিক শক্তির দুর্বলতা দিবালোকের মতো প্রতিভাত হল।
ড. রোমিলা থাপারের মতে, অশোকের মৃত্যুর পর মৌর্য সাম্রাজ্য দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। এই বিভাজন মৌর্য সাজাজ্যকে একেবারে দুর্বল করে দিয়েছিল। এছাড়াও এই বিশাল সাম্রাজ্যকে পরিচালনার জন্য সুদক্ষ শাসকের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অশোক পরবর্তী দুর্বল ও অদক্ষ উত্তরাধিকারীরা সাম্রাজ্যের সংহতি বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল।
মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাঠামোগত দূর্বলতা ও এই সান্তাজ্যের পতনের অন্যতম আগে ছিল। কোন পরীক্ষামূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মচারী নিয়োগ না করে সরকারি কর্তৃপক্ষের ব্যক্তিগত অভিবুচির ওপর নির্ভর করে কর্মচারী নিয়োগ করা হত। ফলে শাসন পরিচালনায় আমলাতন্ত্র কখনো কখনো ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। উদাহরণ হিসাবে তক্ষশিলার বিদ্রোহের কথা বলা যেতে পারে। অশোক আমলাদের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করলেও তাঁর মৃত্যুর পর আমলাতন্ত্রের ওপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে। এর ফলে মৌর্য শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
মৌর্য শাসনের শেষপর্বে প্রজা অসন্তোষ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়। অশোকের মৃত্যুর পর রাজশক্তির পিছনে জনগণের সমর্থন আর ছিল না। আমলাতান্ত্রিক অপশাসন ও উৎপীড়ন যত বৃদ্ধি পায় প্রজা অসন্তোষ ততই তীব্র হয়ে ওঠে। প্রজা সমর্থন যেখানে নেই, সেখানে সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হতে বাধ্য।
ঐতিহাসিক ডি. ডি. কৌশাদী মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের আর একটি কারণ হিসাবে অর্থনীতিকে দায়ী করেছেন। তিনি অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের দুটি লক্ষণকে চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, এই সময় অতিরিক্ত হারে কর চাপানো হয়েছিল। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, মৌর্য আমলের অন্তিম পর্বে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটেছিল। অধ্যাপক রোমিল নাপারও মৌর্য অর্থনীতিকে এই সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন বিশাল সৈন্যবাহিনী, বিরাট আমলাতন্ত্র এবং প্রতিনিয়ত উপনিবেশ দখল, এই সমস্ত কিছুর।
ফলে রাজকোশ প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে, এর ফলে সাম্রাজ্য ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। অশোকের মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সিংহাসনকে কেন্দ্র করে পারিবারিক অন্তর্থন্দু দেখা গিয়েছিল। এই অন্তর্দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে মৌর্য রাজত্বের অস্তিমপর্বে রাজদরবারে দুটি বিবাদমান গোষ্ঠীর জন্ম হয়। যার একদিকে ছিল সেনাপতি পুষ্যমিত্র অন্যদিকে অপর একজন মন্ত্রী। যার ফলে সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
মৌর্য ভারতে অধিবাসীদের মধ্যে কোন রাজনৈতিক ঐক্যও ছিল না। যা তাদের পতনের আরো একটি কারণ। বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কাঠামোই যে আলাদা ছিল তাই নয়, ভাষাও ছিল আলাদা। ফলে ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য গড়ে তোলার পক্ষে তা বাধাস্বরূণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
অতএব বলা যায় যে, সামরিক কার্যকলাপ, ব্রাহ্মণদের ক্ষোভ, গণবিদ্রোহ অর্থনৈতিক চাপ এর কোন কিছুর দ্বারা মৌর্য সাম্রাজ্যের অধোগমনকে সন্তোষজনকভাবে ব্যাখ্যা কর যাবে না। অধোগমনের কারণ ছিল অনেক বেশি বুনিয়াদী চরিত্রের। এই সাম্রাজ্যের অধোগমনের কারণ হিসাবে প্রধানত দায়ী ছিল মাথাভারী প্রশাসন, মুষ্টিমেয় কয়েকজন। বাস্তির হাতেই সমস্ত ক্ষমতা এবং একই সঙ্গে দায়ী করা যায় জাতীয় চেতনার অভাবকে। শুধু মগধের দিকে তাকালে এই কারণগুলিকে ধরা যাবে না। তাই আমরা যদি আমাদের পরিপ্রেক্ষিতকে প্রসারিত করে সমগ্র মৌর্য সাম্রাজ্যের দিকে তাকাই, তাহলে এই সমস্ত কারণের স্পষ্ট সাক্ষ্য পাওয়া যাবে।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ উল্লেখ করো। এই নোটটি পড়ার জন্য