চোল দের স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে কি জানো ? অথবা, চোলদের স্থানীয় শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

চোল দের স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে কি জানো ? অথবা, চোলদের স্থানীয় শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

চোলদের স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে কি জানো ? অথবা, চোলদের স্থানীয় শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য কী ছিল?চোল যুগের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে টাকা লেখো।

চোল দের স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে কি জানো ? অথবা, চোলদের স্থানীয় শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য কী ছিল?

চোলদের স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন ব্যবস্থা


ঐতিহাসিকগণ চোল রাজাদের শাসনকালকে দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে 'সুবর্ণ যুগ' বলে অভিহিত করেছেন। খ্রিষ্টিয় ১০ম শতক থেকে শুরু করে ১২দশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর ধরে নানা বাধা বিপত্তি কাটিয়ে চোলরা এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলে ছিলেন। চোলদের হাতে যে স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসন ব্যবস্থার সূত্রপাত হয়েছিল তা সমসাময়িক অন্যান্য সাম্রাজ্যে দেখা যায় না। চোল শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের নির্ভর করতে হয় লেখ ও লিপির উপর । চোল আমলে পাওয়া মুদ্রা থেকেও চোল শাসনব্যবস্থার অনেক তথ্য পাওয়া যায়। তাছাড়া বৈদেশিক বিবরণ ও অসংখ্য স্থাপত্য নিদর্শন বিশেষ করে মন্দিরগুলি চোল শাসনের বৈশিষ্ঠ্য বা প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে আমাদের সাহায্য করে।


চোলদের স্থানীয় শাসনের অন্যতম ভিত্তি ছিল গ্রাম। চোল গ্রামীণ শাসন এতই স্বাধীন ছিল যে রাজধানীতে রাজার পরিবর্তন হলেও গ্রাম শাসন তার নিজের নিয়মে চলত। গ্রামের শাসন চালাত গ্রামসভাগুলি। গ্রামের শাসনের জন্য বিভিন্ন ধরণের সভা ছিল। গ্রাম গুলিকে কয়েকটি এলাকায় ভাগ করা হত এবং প্রতিটি এলাকায় স্থানীয় সভা ছিল। এই সভায় বিভিন্ন বৃত্তির লোকেদের প্রতিনিধি থাকত। গ্রামে বিভিন্ন গোষ্ঠী ছিল, যা সামাজিক ও ধর্মীয় ভিত্তিতে গঠিত হত। গোষ্ঠীগুলির কাজকর্ম দেখাশোনা করত গোষ্ঠী সমিতি। গ্রামের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা সাধারণ সভায় যোগ দিতে পারত। সাধারণ সভা তিন প্রকারের ছিল, যথা- উর, সভা ও নগরম।


গ্রামের সকল প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ছিল উরের সদস্য, যদিও বর্ষীয়ানরাই উরের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করত। উরের সভাগুলির সদস্য সংখ্যা কত হত তা জানা যায়নি। গ্রামবাসী হিসাবে বা পরিবারের কর্তারা উরে যোগ দিত কিনা তাও জানা যায়নি। তবে গ্রামের প্রতি কুডুস্থ বা পাড়া থেকে প্রতিনিধি দ্বারা উর গঠিত হত। গ্রামের মাথা পিছু খাজনা ধার্য, আদায়, বাঁধ তৈরী, খাল খননের সিদ্ধান্ত প্রভৃতি উরে নেওয়া হত। গ্রামের লোকেদের বিবাদ-বিসম্বাদের নিষ্পত্তি উরে করা হত। আর ব্রাহ্মণ গ্রামগুলির সংগঠন 'সভা' নামে পরিচিত ছিল। চোল যুগে অগ্রহার, ঘেটিকা স্থাপন, মন্দির স্থাপন প্রভৃতি ব্যাপক ভাবে করা হত। ফলে রাজারা ব্রাহ্মণদের বহু ভূমিদান করতেন এবং বহু গ্রামে ব্রাহ্মণেরা সভায় যোগ দিত।


উর ও ব্রাহ্মণ সভা নিয়ে সমিতি গঠন করা হত। উত্তর মেরু লিপি থেকে জানা যায় বিভিন্ন কুডুম্ব বা পাড়া থেকে সমিতি গঠনের জন্য যোগা লোকেদের মনোনীত করা হত। যোগ্যতার মাপকাঠি ছিল বেশ কঠিন। নিজস্ব বাড়ি, ৩৫-৭০ বছর বয়স, শাস্ত্রজ্ঞান, কিছু জমির মালিক প্রভৃতি না থাকলে নির্বাচিত হওয়া যেত না। নৈতিক চরিত্র নির্মল না হলে, সমিতির টাকা-কড়ি আগে তছরুপ না করলে, পরদ্রব্য অপহরণের অপবাদ না থাকলে প্রার্থী হিসাবে যোগ্য মনে করা হত। প্রতি পাড়া থেকে মনোনীত ব্যক্তিদের একজনকে ভাগ্য পরীক্ষায় বেছে নেওয়া হত। সমিতির সদস্যগণ এক বছরের জন্য নিযুক্ত হতেন এবং তাঁরা কোন বেতন পেতেন না।


ঢোল বাজিয়ে সভা বা মহাসভার অধিবেশন ডাকা হত। এই সভা বা মহাসভা গ্রাম সম্প্রদায় ও ব্যক্তির জমির ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে পারত। গ্রামবাসীদের প্রদেয় রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায়, জলসেচ ও পথঘাট রক্ষার দায়িত্ব মহাসভার হাতে ছিল। রাজস্ব আদায় করে তা সরকারের কাছে জমা দেওয়ার দায়িত্বও এর হাতে ছিল। পতিত জমি উদ্ধার করে কৃষি এলাকা বাড়ানোর দায়িত্ব সভা পালন করত। মহাসভা জমি ও জলসেচ অধিকার সংক্রান্ত বিরোধের মীমাংসা করত।


'নগরম' ছিল আধা গ্রাম, আধা শহরের বণিক সভা। কাজের দিক থেকে উর ও সভার মতই ছিল নগরমের দায়িত্ব। কেউ কেউ নগরমকে বণিকদের নিগম বা গিল্ড বলেছেন। এই নিগম গুলি উৎপন্ন শিল্পদ্রব্য কিনে তা অন্যত্র বণ্টন করত। লোকের টাকা-কড়ি জমা রাখা এবং আধুনিক ব্যাঙ্কের মত চড়া সুদে বণিকদের ঋণ দিত। রাজা ও কর্মচারীরা তাদের সঞ্চিত অর্থ এই নগরমে জমা রাখত। ডঃ নীলকান্ত শাস্ত্রী মনে করেন নগরম ছিল একটি অন্যতম স্থানীয় প্রতিষ্ঠান এবং বাণিজ্যস্বার্থ সংশ্লিষ্ঠ এলাকায় একমাত্র সভা বা সংগঠন।


চোল শাসনে গ্রামীণ পর্যায়ে প্রজাসাধারণ যে স্বাধীনতা ভোগ করত সমকালীন ভারতে তা অভূতপূর্ব ছিল। কিন্তু নীলকান্ত শাস্ত্রী প্রমুখ ঐতিহাসিকেরা বলতে চেয়েছেন, চোল আমলে গ্রামগুলিতে স্বায়ত্ত-শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত থাকলেও সর্বস্তরের মানুষের উন্নতি হয়নি। এই শাসনে উপকৃত হয়েছিল কেবল সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষ, সাধারণ মানুষ অবহেলিত ছিল। তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে চোল আমলে সমাজে যথার্থ সাম্য প্রতিষ্ঠিত না থাকলেও ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেনি। বরং উভয় শ্রেণীর মধ্যে পারস্পরিক আদান প্রদানের শুভ মানসিকতা সক্রিয় ছিল। ধনীরা দরিদ্রের জন্য অকাতরে দান-ধ্যান করতেন। জনগণের প্রদেয় রাজস্বের একাংশ সেবামুলক প্রকল্পের মাধ্যমে ফিরে আসত।


পরিশেষে তাই বলা যায়, চোল আমলে গ্রামীন স্বায়ত্ত-শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে আধুনিক স্বায়ত্ত-শাসনের তুলনা করা যেতে পারে। চোলরা গ্রামগুলিকে যে স্বাধীনতা দিয়েছিল এবং গ্রাম শাসনের ব্যাপারে গ্রামবাসীদের ক্ষমতা ও অধিকার স্বীকার করে নিয়েছিল, তা চোল শাসনব্যবস্থাকে এক বিশিষ্টতা দান করেছে। অধ্যাপিকা রোমিলা থাপার চোলদের স্থানীয় শাসন-ব্যবস্থা প্রসঙ্গে বলেছেন, 'চোল কর্মচারীরা গ্রামের শাসনব্যবস্থায় শাসকের পরিবর্তে পরামর্শদাতার ভূমিকা নিত। এই কারণে দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব গ্রামে বেশি পড়ত না এবং গ্রামগুলি অব্যাহত গতিতে উন্নতি লাভ করেছিল। উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় তামিলনাদে যে অনেক বেশি সাংস্কৃতিক অবিচ্ছিন্নতা লক্ষ্য করা যায়, তার মূলেও হয়তো রয়েছে চোলদের গ্রাম শাসন পদ্ধতি'।

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟