বিংশ শতকের সূচনায় ভারতীয় চিত্রকলা রীতির আবির্ভাবে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান বিবৃতি কর
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার একজন অন্যতম পথিকৃত ৷ নব্য বঙ্গীয় চিত্তরীতি জনকও তিনিই ৷ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির এই কীর্তিপুরুষটি ছোটবেলায় অঙ্কনের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং অয়েল পেইন্টিং শিখিয়েছিলেন বিদেশে শিল্পীদের কাছে । শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরামর্শে তিনি ভারতীয় সনাতন চিত্রাঙ্কন রীতি পুনরুদ্ধারের সাধনা শুরু করেন ৷ তার চিত্রচর্চার বিষয় হল বৈষ্ণব পদাবলী ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
এই বৈষ্ণব পদাবলী কে অবলম্বন করে তিনি এঁকেছিলেন বিখ্যাত 'শ্বেত অভিসারিকা', তারপরেই কৃষ্ণলীলা সিরিজের ছবিগুলি তাকে বিশেষ খ্যাতি এনে দিয়েছিল ৷ বলা হয় যে এই কৃষ্ণলীলা সিরিজের ছবিগুলির মাধ্যমে আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার জয়যাত্রা শুরু হয় । চিত্রশিল্পী হিসাবে তিনি এই সময় সবথেকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেতে থাকেন ৷
অবনীন্দ্রনাথের প্রধান দক্ষতা ছিল জলরঙের ওয়াশ পদ্ধতিতে চিত্ত রচনায় ৷ এই পদ্ধতিটি ছিল তার কাছে একটি নিজস্ব আবিষ্কার ছবিকে বারবার ধুয়ে তিনি সম্পূর্ণরূপ প্রদান করতেন ৷ যার ফলে ছবিতে ব্যবহৃত রং এর চরিত্রা হয়ে উঠতো মৃদু ৷
অবনীন্দ্রনাথ ভারতীয় শিল্পশৈলীর সাথে পাশ্চাত্যের শিল্প শৈলী মিশিয়ে এক নতুন অঙ্গীকের শিল্প রিতির প্রবর্তন করেন ৷ ১৯০৫ সালে কলকাতায় সরাসরি আর্ট স্কুলের তৎকালীন অধ্যক্ষ হ্যাভেল তাকে সরাসরি আর্ট স্কুলের সহদোক্ষা নিযুক্ত করেন ৷ ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ৷ তার প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন নন্দলাল বসু,অতীশ কুমার হালদার প্রমুখ ৷ 1912 সালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর CIE উপাধিতে ভূষিত হন । ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'বাগেশ্বর অধ্যাপক' পদ অলংকৃত করেন এবং রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর কিছুদিন বিশ্বভারতীর আচার্য হিসাবে কাজ করেন ।
অবনীন্দ্রনাথ চন্ডীদাসের পদাবলী অবলম্বনে যে চিত্র অঙ্কন করেন তা তার শিল্প ভাবনা বিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় ৷ এছাড়াও তিনি যেসব ছবি আঁকেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল 'শাহজাহানের মৃত্যু','কয়েদি বাহাদুর শাহ' ইত্যাদি ৷ উড়িষ্যার ভ্রমণকালে কোনারকের মন্দির সহ উড়িষ্যার বিভিন্ন স্থাপত্য ভাস্কর্য তার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে ৷ এ সময়ে ছবিগুলি মধ্যে 'দেবদাসী','কাজুরি নৃত্য','কথক ঠাকুর' ইত্যাদি বিখ্যাত ছিল ৷ এছাড়াও 'পথিক ও পথ', 'পুষ্পধারা' ,'কবি কঙ্কন','গান্ধীজী','রবীন্দ্রনাথ' ইত্যাদি ছবি যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল ৷
'ভারত মাতা' ছাড়াও 'গণেশ জননী' তার একটি বিখ্যাত ছবি ৷ এছাড়াও 'ঔরঙ্গজেব বাদশা','শেষ বোঝা','অভিসার','শাস্তির বারবার' ইত্যাদি তার বিখ্যাত চিত্রমালার অন্তর্গত ৷ সঙ্গীত ও সাহিত্যের অল অঙ্গনেও অবনীন্দ্রনাথের বিচরণ ছিল সাবলীল ৷ তার রচিত 'শকুন্তলা','রাজকাহিনী','ক্ষীরের পুতুল' খুবই বিখ্যাত ৷ তিনি বহু কবিতা ও ছোটগল্প রচনা করেন তার প্রদত্ত বক্তৃতা 'বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী' গ্রন্থে মুদ্রিক আকারে সংকলিত আছে ৷
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন শিল্পী যাকে বিধাতা তার হাতে তুলিও বর্ণের ভান্ডার দিয়ে পাঠিয়েছিলেন ৷ তার প্রবন্ধে ও নিবন্ধে সেই রঙে ছোঁয়া লক্ষ্য করা যায় ৷ প্রাচীন মধ্যযুগের ভারতবর্ষে পদচারণা করেও তিনি যে তথ্য ও চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তা অনবদ্য ৷ এই কারণেই ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ভারতীয় শিল্পের জনক বা শিল্পের গুরু বলে অভিহিত করা হয় । ভারতীয় তথা বাংলা চিত্রকলার ইতিহাসে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অনস্বীকার্য ৷