মুঘল চিত্র শৈলির ওপর একটি প্রবন্ধ লেখো
ভারতে মুঘল শাসকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো যে চূড়ান্ত স্বৈরাচারী মানসিকতা সম্পন্ন হলেও তাদের প্রতিভা এবং উদ্যম কেবলমাত্র সাম্রাজ্য বিস্তার কিংবা দরবারী রাজনীতির টানা পড়ানোর মধ্যে নীঃশেষ হয়ে যায়নি ৷ তরবারিকে সীমিত করার পাশাপাশি কলমের প্রতি কালিভরা কিংবা তুলিতে রং মাখানোর কাজ ও তারা আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করেছিল ৷ মুঘল স্থাপত্য শৈলীর চিত্রকলার অস্তিত্বকে কিছুটা আড়াল করে রাখলেও তারূপ, রং এবং মনণশীলতা সুজনীদের সমাদার থেকে বঞ্চিত হয়নি ৷ স্থাপত্য শিল্পের বিকাশের সাথে চিত্রকলা চর্চা অগ্রগতির মধ্যে কিছুটা মিল ও লক্ষ্য করা যায় ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
![]() |
তৈমুর বাড়ির রাজকুমার, পারস্যের জন্য দায়ী আব্দ আস-সামাদ, c. 1550-1555, পরবর্তী শতাব্দীতে সংযোজন সহ জাহাঙ্গীর |
স্থাপত্য শিল্প যেমন পারসিক শিল্প দর্শন থেকে রস সংগ্রহ করে ভারতের মাটিতে ভারতীয় শিল্প দর্শনের মিলনে নতুনভাবে অঙ্কুরিত হয়েছিল ৷ চিত্রকলাতেও তেমনি ভারতীয় ও পারসিক রসের সমন্বয়ে এক স্বতন্ত্র চিত্রশৈলী হিসেবে নিজেকে প্রকাশিত করেছে ৷ মুঘল চিত্রশিল্পের বিষয়বস্তু ছিল কঠোর বাস্তব সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনা,প্রাকৃতিক দৃশ্য,গাছ,পশুপাখি প্রভৃতি মুঘল চিত্রশিল্পের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় । মুঘল চিত্রকলার ভারতীয় রীতির সঙ্গে বৌদ্ধ,ইরানীয় শিল্পীর ও রীতি এক অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায় ৷
বাবর ও হুমায়ন অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য দুজনেই চিত্রকলা ও শিল্পে তেমন অবদান না রেখে যেতে পারলেও বাবরও যে সৌন্দর্য ও প্রকৃত প্রেমিক ছিল তা তার আত্মজীবনীতে আভাস পাওয়া যায় । হুমায়ুনের ভাগ্য বিপর্যয় পারস্যের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ঘটনা বস্তুত মুঘল চিত্রকলার সূচনা সম্ভাবনা সৃষ্টি করে ৷ পারস্যের দুই বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মীর সৈয়দ আলী এবং আব্দুস সামাদের সাথে তিনি পরিচিত হন এবং কাবুরে তার অস্থায়ী রাজধানীতে তাদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন ৷ সেখান থেকে তারা হুমায়ূনের সঙ্গে দিল্লিতে আসেন এবং চিত্রশিল্পীর কাজে আত্মনিয়োগ করেন ৷
স্থাপত্যের মতোই মমতা ও একাগ্রতা দিয়ে মহান সম্রাট আকবর চিত্রকলাকে লালন-পালন করেন ৷ ঐতিহাসিক জাফর লিখেছেন,"আকবর ভারতীয় চিত্রকলা কে পুরানুকরণের কাল থেকে মুক্ত করে এক একে একটি নতুন নিরাপদ দৃঢ় ভিত্তি দেন৷" প্রকৃতির স্বাভাবিক সৌন্দর্যের প্রতি আকবরের গভীর অনুরাগ ছিল ৷ সম্রাট আকবর চিত্রকলা প্রসারের ওপর জোর দেন ৷ আকবর বলেন,"অনেকে চিত্রকলাকে ঘৃণা করেন, আমি তাদের অপছন্দ করি না ৷ আমার মতে চিত্তকরের পক্ষে ঈশ্বরকে জানার একটা সক্রিয় উপায় আছে ৷ কারণ চিত্রকর যখন এমন কিছু আঁকতে যাই যার প্রাণ আছে যখন সে একের পর এক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অঙ্কন করে তখন সে উপলব্ধি করে তার জ্ঞান রচিত হয় ৷" আবুল ফজলের 'আইন-ই- আকবরী' গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে আকবর চিত্রাংকনকে একাধারে শিল্প ও মনোরঞ্জনের মাধ্যম বলে বিবেচনা করতেন ।
জাহাঙ্গীরের আমলে মুঘল চিত্রশিল্পের স্বর্ণযুগ শুরু হয় ৷ জাহাঙ্গীর নিজ আত্মজীবনীতে লিখেছেন,"একাধিক চিত্রকরের আঁকা একই ধরনের বহু ছবি সামনে রাখলে আমি নিমেষেই বলতে পারি যে কোনটি কোন চিত্র করের ৷ এমনকি একাধিক শিল্পী দ্বারা একটি মাত্র ছবি অংকন করলেও আমি বলতে পারি ছবির কোন অংশটি কোন চিত্র কর এঁকেছেন ৷" তবে স্যার টমাস রো বলেছেন," জাহাঙ্গীর ছিলেন উন্নত মানের চিত্ত সংগ্রাহক, বিদেশি চিত্র তার স্থান পেয়েছিল তার সংগ্রহশালা ৷ জাহাঙ্গীরের আমলের চিত্র কলকাতা জাদুঘরে তে সংরক্ষিত আছে । জাহাঙ্গীরের চিত্তের পাশাপাশি বিশিষ্ট ব্যক্তি গায়ক ও সাধারণ মানুষের প্রতিকৃতি ও অংকন চিত্রকরদের বিশেষ আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয় ।
জাহাঙ্গীরের পুত্র শাহজাহান সৌন্দর্যের পূজারী ছিলেন ৷ তিনি পিতার শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পের প্রতি অনুরাগী না হয়ে জাঁকজমকপূর্ণ স্থাপত্য শিল্পের দিকে অনুরাগী হওয়ায় চিত্রশিল্প অবহেলিত হয় । তার রাজত্বকালে অঙ্কিত চিত্র গুলির মধ্যে শিল্প অপেক্ষার রঙের অতি শয্যা ও আরম্ভর অধিক পরিমাণে দেখা যায় ৷ শাহজাহানের রাজত্বকালের একটি পূর্ণ চিত্রায়ন ছিল 'শাহজাহান নামার' চিত্রায়ন ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত ৷ শাহজাহানের সুফি নৃত্য দর্শন চিত্রটি বিশেষত্বের দাবি রাখে ৷