ভার্সাই চুক্তির/সন্ধি সম্পর্কে লেখ অথবা, ভার্সাই চুক্তির (Treaty of Versailles) শর্তগুলি কী ছিল?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে 1919 খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে বিজয়ী মৃত্যু শক্তিবর্গ পরাজিত জার্মানির সাথে ভার্সাই এর সন্ধি স্বাক্ষর করেন ৷ বিজয়ী মিত্রশক্তি একতরফাভাবে জার্মানিকে যুদ্ধে অপরাধী ঘোষণা করে এই সন্ধি করে ভাষায় সন্ধি ছিল মার্কিন রাষ্ট্রপতির উইলসনের আদর্শবাদ ফরাসি প্রধানমন্ত্রীর বাস্তববাদ এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জের সুবিধাবাদের ফলস্বরূপ জার্মানির আপত্তিকেও অগ্রাহ্য করে এই সন্ধির স্বাক্ষরে বাধ্য করায় জার্মানির এই সন্ধি বিরোধিতা করে ৷
সন্ধির প্রধান নীতিঃ
- বিশ্বযুদ্ধের বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানিকে দোষী করা হয়।
- ভবিষ্যৎে-জার্মানি খাতে কিছুশানিতে কোনো বিঘ্ন ঘটাতে না পারে তার উপযুক্ত ব্যাবস্থা হয়,
- সমগ্র -ইউরোপে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখা, 'N) মার্কিন রোষ্ট্রপতি উেড্রো উইলসকোর ১৪ দফা শর্তকে বাস্তবায়িত করা।
- জার্মানির ভবিষ্যৎ আরম্প থেকে ফ্রান্সের নিরাপত্তা রক্ষা করা।
- বিশ্বশান্তি বজায় রাখতে আন্তর্জাতিক সংস্থ প্রতিষ্ঠা করা।
শর্তাবলী
৫১০-টি-অধ্যায়ে বিভক্ত ২৫০ পৃষ্ঠার ভার্সাই সন্ধির স্থূল ধারা গুলি ছিলো-
আঞ্চলিক পুনর্গঠনঃ ভার্সাই চুক্তির শর্ত হিসাবে জার্মানির বিভিন্ন দেশকে বিভিন্ন অঞ্চল ছেড়ে দিতে হবে যেমন
- ফ্রান্সকে তার হারানো কয়লা খনি আলসাস ও লৌহ খনি লোরেন্স ফিরিয়ে দিতে হবে
- বেলজিয়াম মন্গেরেট ইউপেন পাবে
- ডেনমার্ক স্লেস উইক অঞ্চল লাভ করে,
- পোল্যান্ডের সমুদ্র পথ যোগাযোগের সুবিধার জন্য জার্মানির মধ্য দিয়ে পোলিশ করিডোর নামক রাস্তা তৈরি করা হবে।
- এশিয়া ও আফ্রিকায় অবস্থিত জার্মানির বিভিন্ন উপনিবেশ গুলি মিত্র শক্তিবর্গ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে
- জার্মানির দানজিক বন্দরকে সকলের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে ৷
অর্থনৈতিকঃ ভার্সাই সন্ধিতে জার্মানির উপর মিত্রপক্ষ যেসব কঠোর অর্থনৈতিক শর্ত চাপিয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল
- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানিকে দায়ী করে ৬৬০ কোটি পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দায়ী জার্মানির উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়
- জার্মানি কে পদ্ধতিতে ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করবে তার জন্য একটি ক্ষতিপূরণ কমিশন গঠিত হবে
- জার্মানি তার অধিকাংশ বাণিজ্য পথ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে সমর্পণ করবে
- জার্মানির সমৃদ্ধ কয়লা খনি অঞ্চল ফ্রান্সের অধীনে থাকবে
- ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম, ইত্যাদি দেশকে জার্মানি বাধ্যতামূলক কয়লা,লৌহ,কাঠ,রবার ইত্যাদি যোগান দেবে ৷
সামরিকঃ ভার্সাই সন্ধিতে জার্মানির উপর আরোপিত সামরিক শর্ত গুলি হল
- জার্মানি সৈন্য সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে এবং সেনা শুধুমাত্র জার্মানির অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলার সুরক্ষা নেবে,
- জার্মানিতে বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক শিক্ষা গ্রহণ নিষিদ্ধ থাকবে
- জার্মানি তার সমস্ত যুদ্ধজাহাজ গুলি ইংল্যান্ডকে দিতে বাধ্য থাকবে
- জার্মানিতে ট্যাংক বোমারু বিমান কামান প্রভৃতি উৎপাদন নিষিদ্ধ হবে
- রাইন নদীর পূর্ববর্তী ৩০০ মাইল অঞ্চলে অবস্থিত সমস্ত জায়গার সব জার্মান সামরিক ঘাঁটি ও দুর্গ ভেঙে ফেলা হবে।
- ২২৮ এবং ২৩১ নম্বর ধারা অনুযায়ী সম্রাট কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম ও জার্মান সেনাপতিদের বরখাস্ত করা হবে
- এই সন্ধির সব শর্তগুলি যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কিনা সে দিকে নজর রাখার জন্য জার্মানির সহচরে জার্মানিকে মিত্র পক্ষের একটি সেনা দল মতান থাকবে
ঐতিহাসিক,গবেষক ও সমালোচকগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভার্সাই চুক্তি/ সন্ধিকে সমালোচনা করেছেন ৷ এই সন্ধিকে কেউ মৃত্যু পরিকল্পনা কেউ আবার অমানবিক অনুদার কেউ আবার জবরদস্তি মূলক সন্ধি বলে উল্লেখ করেছেন। সন্ধির মাধ্যমে জার্মানির উপর যেভাবে জোর জবরদস্তি করে ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং তার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল বিশ্ব ইতিহাসে এরূপ নমুনা আর কোন সন্ধিতেই নেই। ঐতিহাসিক ল্যাস্কির মতে জার্মানির ওপর প্রতিশোধের জন্য মিত্র শক্তি এই অমানবিক সন্ধির শর্তগুলি চাপিয়ে দিয়েছিল ৷
যুদ্ধ সৃষ্টির অপরাধে ভার্সাই সন্ধির মাধ্যমে মিত্রপক্ষ জার্মানির প্রতি যে চরম অনদারতা দেখিয়েছিল তা ছিল অবশ্যই নিন্দনীয় ৷ জার্মানির ভূখণ্ড অধিকার করা থেকে শুরু করে, উপনিবেশ দখল, সম্পদ অধিকার ইত্যাদি দরুন এই সন্ধির অনুদার সন্ধি হয়ে ওঠে, এই চরম অনুদারতার বিরুদ্ধে সমগ্র জার্মানি জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় ৷ জার্মানরাও এর যোগ্য জবাব দিতে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে ৷
সুতরাং পরিশেষে বলা যায় ভার্সাই সন্ধি এমন এক সন্ধি যেখানে সমস্ত দেশেরই যুদ্ধের দায়ী হবার সত্ত্বেও শুধুমাত্র যুদ্ধের জন্য জার্মানিকেই দায়ী করে তার ওপর সমস্ত ক্ষতিপূরণ চাপিয়ে দেওয়া হয়। যা ছিল ও জার্মানির কাছে অত্যন্ত অপমান ও লজ্জাজনক এই সন্ধির মাধ্যমেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল ৷