সাম্রাজ্যবাদ কী? সাম্রাজ্যবাদ প্রসারের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।

 সাম্রাজ্যবাদ কী? সাম্রাজ্যবাদ প্রসারের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর। অথবা, ঔপনিবেশিকতাবাদ কী? ঔপনিবেশিকতাবাদ প্রসাবের কারণ কী? এর প্রভাব আলোচনা কর। অথবা, সাম্রাজ্যবাদের উদ্যেশ্য কী ছিল? উপনিবেশগুলির ওপর ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব আলোচনা কর। অথবা, ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ বলতে কী বোঝ? ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ প্রসাবের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর। অথবা,উপনিবেশবাদের রাজনৈতিক ভিত্তি সম্পর্কে আলোচনা কর। সাম্রাজ্যবাদের তাৎপর্য বা পরিণতি কী হয়েছিল?

সাম্রাজ্যবাদ কী? সাম্রাজ্যবাদ প্রসারের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর। অথবা, ঔপনিবেশিকতাবাদ কী? ঔপনিবেশিকতাবাদ প্রসাবের কারণ কী? এর প্রভাব আলোচনা কর। অথবা, সাম্রাজ্যবাদের উদ্যেশ্য কী ছিল? উপনিবেশগুলির ওপর ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব আলোচনা কর। অথবা, ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ বলতে কী বোঝ? ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ প্রসাবের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর। অথবা,উপনিবেশবাদের রাজনৈতিক ভিত্তি সম্পর্কে আলোচনা কর। সাম্রাজ্যবাদের তাৎপর্য বা পরিণতি কী হয়েছিল?


সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ ল্যাটিন শব্দ 'ইম্পোরিয়াম' থেকে 'ইম্পেরিয়ালিজম' বা 'সাম্রাজ্যবাদ' কথাটির উৎপত্তি হয়েছে। এর অর্থ 'সামরিক কর্তৃত্ব'। আর 'সাম্রাজ্যবাদ' বলতে বোঝায় কোনো একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র কর্তৃক অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্র বা জাতির ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার তত্বকে। বর্তমানে যে-কোনো দেশ কর্তৃক বিদেশ নীতি হিসাবে যে আগ্রাসনমূলক বিস্তার নীতি গ্রহণ করা হয় তাকে সাম্রাজ্যবাদ বলা হয়। চার্লস বেয়ার্ডের মতে, 'কোনো একটি রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ড দখল করে তার ওপর দখলদারী রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই হল সাম্রাজ্যবাদ'। লেনিন বলেছেন, সাম্রাজ্যবাদ হল পুঁজিবাদের চূড়ান্ত পর্যায়'।


অন্যদিকে, কোন দেশ সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতাকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে অন্য কোনো দেশে বসতি গড়ে তোলার নীতি নেয় ও শাসন শুরু করে তখন তা উপনিবেশবাদ হিসাবে বিবেচিত হয়।


সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের সম্পর্ক সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ প্রায় সমার্থক। এ প্রসঙ্গে রবার্ট ইয়োং বলেছেন, 'সাম্রাজ্যবাদ কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত একটি রাষ্ট্রনীতি, অর্থনৈতিক কারণে আদর্শগতভাবে যারূপায়িত; অন্যদিকে উপনিবেশবাদ হল বসতি বিস্তার অথবা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত'।


অর্থাৎ উপনিবেশবাদের ভিত্তি রচনা করে সাম্রাজ্যবাদ। (তাই উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে পরস্পর নির্ভরতার সম্পর্ক বিদ্যমান।) [ আর উপনিবেশ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে যখন সাম্রাজ্যবাদী নীতি কার্যকর করা হয় তখন তাকে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ বলে।]


সাম্রাজ্যবাদ (উপনিবেশবাদ) প্রসারের কারণ (উদ্দেশ্য):


বিভিন্ন ঐতিহাসিক আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের প্রসারের বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেন যেগুলি বিশ্লেষণ করলে এর উদ্দেশ্যে ও রাজনৈতিক ভিত্তি সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়।।


যেমন


১. রাজনৈতিক কারণ:

  1.  উগ্র জাতীয়তাবাদ: ১৮৭০ সালের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দেয়। প্রতি জাতি নিজেদের শ্রেষ্ঠ্যত্ব প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে তারা এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলিতে উপনিবেশ বৃদ্ধি করে শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা চালায়।
  2. ক্ষমতার আকাঙ্খা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের সম্মান, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হয়।


২. অর্থনৈতিক কারণ:

  1. পণ্য বিক্রির বাজার শিল্পবিপ্লবের কারণে ইউরোপের প্রায় সব দেশই শিল্পোন্নত ছিল এবং তাদের চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত পণ্য উদবৃত্ত হত। এই উদবৃত্ত পণ্য বিক্রির উদ্দেশ্যে উপনিবেশের প্রসার ঘটায়।
  2. কাঁচামাল সংগ্রহ: সপ্তায় শিল্প কারখানার প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলি সুকৌশলে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে ঔপনিবেশিক শাসন শুরু করে।
  3. পুঁজি বিনিয়োগ: হবসনের মতে, ইউরোপীয় পুঁজিপতিরা শিল্পবিপ্লবের ফলে প্রাপ্ত বিপুল মুনাফা বিনিয়োগ করার জন্য উপনিবেশ স্থাপনে আগ্রহ দেখায়। লেনিনের মতে, পুঁজিপতিরা বাজার দখলের চেয়ে উপনিবেশে পুঁজি বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী ছিল। 


শ্রমিক সংগ্রহ: শিল্পোৎপাদনের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ এবং কারখানায় কায়িক শ্রমের জন্য প্রচুর সস্তার শ্রমিক প্রযোজন ছিল। এই শ্রমিকের জোগান অব্যাহত রাখার জন্য ইউরোপীয় দেশগুলি উপনিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করে।


৩. সামরিক কারণ:


  1. নিরাপত্তা বৃদ্ধির চেষ্টা: সাম্রাজ্যবাদের যুগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়। ফলে বিভিন্ন দেশ নিরাপত্তার অভাব বোধ করতে থাকে। তাই নিজ দেশের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে অনেকেই উপনিবেশ দখল করে। যেমন, সাইপ্রাস ও কেপের মতো নৌঘাটি ইংল্যান্ড শুধুমাত্র নিরাপত্তার কারণেই দখল করেছিল।
  2. সামরিক মর্যাদা বৃদ্ধি: ইউরোপের বিভিন্ন দেশ নিজেদের সামরিক শক্তি ও মর্যাদা তুলে ধরার জন্য উপনিবেশ স্থাপনের পথ বেছে নেয়।


৪. সামাজিক কারণ:


  1. জনসংখ্যা বৃদ্ধি: উনবিংশ শতকের শেষ দিকে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশেই জনসংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। এই বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
  2. সভ্যতার প্রসার: ইউরোপের কোনো কোনো সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাবিদ (যেমন, জুলি ফেরি, রুডইয়ার্ড কিপলিং) মনে করতেন যে, এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত মানুষদের প্রতি ইউরোপীয়দের কিছু 'দায়বদ্ধতা' আছে। তথাকথিত এই দায়বদ্ধতা 'সাদা চামড়ার দায়বদ্ধতা' নামে পরিচিত। এই দায়বদ্ধতাও তাদেরকে উপনিবেশ স্থাপনে উৎসাহিত করেছে বলে কেউ কেউ মনে করেন।


৫) ধর্মীয় কারণ:

  1. ধর্মপ্রচার: ইউরোপের খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারকরা ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে নিজ নিজ দেশে বণিক ও রাজনীতিবিদদের উৎসাহিত করত উপনিবেশ স্থাপনে।
  2. মানব সম্পদ: কারও কারও মতে, খ্রিষ্টান মিশনারিরা মানব কল্যাণ এবং নিপীড়িত জনগণের মঙ্গল সাধনের উদ্দেশ্যে উপনিবেশ স্থাপনে উৎসাহিত হয়েছিলেন।
  3. প্রযুক্তিগত কারণ: আধুনিক ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ সাম্রাজ্যবাদের উপাদান হিসাবে প্রযুক্তিবিদ্যার ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছেন তাদের মতে উন্নত প্রযুক্তিতে গড়ে ওঠা 'ব্রিটিশ নেভী লীগ' জার্মান নেভী লীগ' প্রভৃতি নৌ সংগঠনগুলি উপনিবেশ দখলের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করত। বস্তুত্ব: ইউরোপীয় নবজাগরণ এবং তার প্রভাবে ঘটে যাওয়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভূতপূর্ব অগ্রগতি সারা পৃথিবীকে ইউরোপীয়দের হাতের মুঠোয় এনে দেয়। আর সেটাকে কাজে লাগিয়েই তারা পুরো দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে যা উপনিবেশবাদের রাজনৈতিক ভিত্তি রচনা করে।


সাম্রাজ্যবাদ (উপনিবেশবাদ) প্রসারের ফলাফল। তাৎপর্য (প্রভাব): 


এশিয়া মহাদেশ, নতুন বিশ্ব ও পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে ইউরোপীয়দের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার ফলাফল ও তাৎপর্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

  1. সামুদ্রিক বাণিজ্য বৃদ্ধি: পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইউরোপীয়দের ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম হলে এশিয়া, আমেরিকা (নতুন বিশ্ব), ও আফ্রিকার মধ্যে সামুদ্রিক বাণিজ্যের সূত্রপাত ঘটে। ফলে ইউরোপের বাণিজ্য আরও সমৃদ্ধ হয়। ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯) প্রাক্কালে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের অন্তত ৪০ শতাংশ বাণিজ্যই উপনিবেশগুলির সঙ্গে চলত।
  2. সীমাহীন শোষণ: উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইউরোপীয় দেশগুলি উপনিবেশকে কাঁচামাল রপ্তানির কেন্দ্র ও শিল্পপণ্য বিক্রির বাজার হিসাবে গড়ে তোলে। এর সাথে নানা রকম শোষণমূলক কর চাপায়। এভাবে আর্থিক শোষণ লাগামহীন হয়ে ওঠে।
  3.  মুদ্রাস্ফীতি বা মূল্যবিপ্লব: অষ্টাদশ শতকে আমেরিকা থেকে বিপুল পরিমানে সোনা ও রুপা ইউরোপে আমদানি হয়। ফলে ইউরোপে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। এই মুদ্রাস্ফীতির কারণে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে যা মূল্যবিপ্লব নামে পরিচিত।
  4.  দারিদ্র বৃদ্ধি: মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে ইউরোপের দরিদ্র মানুষের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। কারণ মূল্যবৃদ্ধি হলেও শ্রমিকের মজুরি তেমন বাড়ে নি। ফলে কিছু মানুষ সম্পদশালী হলেও দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়ে পরে।
  5. পুঁজিপতি শ্রেণির উত্থান: দক্ষিণ আমেরিকার সোনা ও রুপা সহ বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে একশ্রেণির বণিকদের হাতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ জমা হয়। এভাবে ইউরোপে পুঁজিপতি বা ক্যাপিটালিস্ট শ্রেণির জন্ম হয়।
  6.  শিল্পের অগ্রগতি: এই উদ্বৃত্ত পুঁজি, উপনিবেশ থেকে কাঁচামাল আনার সুবিধা ও সেখানকার বাজারকে ব্যবহার করে ইউরোপে শিল্পোৎপাদনে আমূল পরিবর্তন
  7. ঘটে যায়। ফলে ইউরোপে শিল্পবিপ্লব ঘটে যায়। প্রথমে ইংল্যান্ডে এবং পরে সমগ্র ইউরোপে তা ছড়িয়ে পরে।
  8.  বিশ্ব অর্থনীতির উদ্ভব এশিয়া আফ্রিকা ও আমেরিকায় ইউরোপীয়দের বিভিন্ন উপনিবেশ গড়ে উঠলে এই সব অঞ্চলে তাদের অর্থনীতির প্রসার ঘটে। এভাবে সপ্তদশ শতকে ইউরোপে বিশ্ব অর্থনীতির উদ্ভব ঘটে।


এভাবে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতক জুড়ে পৃথিবীর রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিত্রপটকে আমূল পাল্টে দেয়।




About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟