১৮৭১ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত জার্মানির বিসমার্কের পররাষ্ট্রনীতি আলোচনা কর বা,বিসমার্কের সময় জার্মান পররাষ্ট্রনীতি কি ইউরোপে একটি নতুন শক্তিসাম্যের সৃষ্টি করেছিল। বা,১৮৭১-১৮৯০ সাল পর্যন্ত বিসমার্ক কীভাবে ইউরোপীয় শক্তির সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল?
ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কূটনীতিবিদ ছিলেন বিসমার্ক ৷ ১৮৭১ সালে জার্মান সাম্রাজ্য গঠিত হবার পর থেকে ১৮২০ সালে বিসমার্কের পদচ্যুতি পর্যন্ত সময়কে বিসমার্কের যুগ বলা হয় ৷ ১৮৭১ সাল থেকে বিসমার্কের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য ছিল নবগঠিত জার্মান সাম্রাজ্যের সংহতি বজায় রাখা,ইউরোপের জার্মানির ক্ষমতা বৃদ্ধি করা ও আধিপত্য রক্ষা করা ৷
বিসমার্কের বিদেশ নীতির অন্যতম লক্ষ্য ছিল ফ্রান্সকে ইউরোপের অন্যান্য শক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা ৷ তিনি জানতেন যে ফ্রান্সের প্রথম ফ্রাঙ্ক-প্রাশিয়ান যুদ্ধের পরাজয়ের অপমান সহ্য করা সম্ভব নয় ৷ তাই ফ্রান্স যতদিন মিত্রহীন ততদিন সে জার্মানির পক্ষে বিপদজনক নয় । ফ্রান্সকে মিত্রহীন করার জন্য তিনি অস্ট্রিয়া, ইতালি, ব্রিটেন ও রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের চেষ্টা করেন ৷
১৮৭২ সালে বিসমার্ক অস্ট্রিয়া রাশিয়া ও জার্মানির নরপতিদের মধ্যে এক বন্ধুত্বের চুক্তি সম্পাদন হয় ৷ এই চুক্তি তিন সম্রাট চুক্তি নামে পরিচিত ৷ কিন্তু এই বন্ধুত্ব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি ৷ বলকান অঞ্চলে অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার স্বার্থ ছিল পরস্পর বিরোধী । ১৮৭৮ সালে বার্লিন কংগ্রেসের বিসমার্ক অস্ট্রিয়াকে সমর্থন করে। এতে রাশিয়া ক্ষুদ্র হয় ফলে ভেঙে যায় তিন সম্রাটের চুক্তি ৷
বিসমার্ক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ১৮৭৯ সালে একটি গোপন চুক্তি সম্পাদন করেন যা দ্বৈত চুক্তি নামে পরিচিত ৷ এই যুক্তির দ্বারা স্থির হয় যে এক পক্ষ যদি রাশিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে অপরপক্ষ তাকে সাহায্য করবে ৷ অন্য কোন শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হলে নিরপেক্ষ থাকবে । তবে আক্রমণকারীর দেশ রাশিয়ার সাহায্য নিলে উভয়পক্ষ মিলিতভাবে যুদ্ধ করবে এই চুক্তি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বলবৎ ছিল ৷
বিসমার্ক বুঝতে পারেন যে রাশিয়াকে স্বপক্ষে না রাখলে রাশিয়া ফ্রান্সের পক্ষে যোগ দেবে এই কারণে তিনি পুনরায় জার্মানি অস্ট্রিয়া রাশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয়বার তিন সম্রাট মৈত্রী গড়ে তোলার চেষ্টা করেন ৷ এর ফলে ১৮৮১ সালে জার্মানি অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় বার তিন সম্রাট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । কিন্তু এবারে অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে চুক্তি বেশিদিন তাই হয়নি ৷ বুলগেরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া প্রায় মুখোমুখি হয়েছিলেন এই সময়ে এই জার্মানি অস্ট্রিয়াকে সমর্থন করলে রাশিয়া ক্ষুদ্ধ হয় এবং দ্বিতীয় তিন সম্রাট চুক্তি ভেঙ্গে যায় ৷
ফ্রান্সের সঙ্গেই ইতালির যাতে বন্ধুত্ব গড়ে না উঠে সেদিকেও বিসমার্ক লক্ষ্য রেখেছিলেন তাই তিউনিস নিয়ে ফ্রান্স ও ইতালির মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বিসমার্ক ইতালি কে সমর্থন করে ৷ বিসমার্কের চেষ্টা ১৮৮২ সালে জার্মানি ইতালি ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে ত্রিশক্তি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ৷ এই চুক্তি দ্বারা স্থির হয় যে ফ্রান্সের দ্বারা আক্রান্ত হলে চুক্তি সম্পাদনকারী রাষ্ট্রগুলি ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে ৷
দূরদর্শী বিসমার্ক যে কোন উপায়ে রাশিয়ার সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে আগ্রহী ছিলেন ৷ বিসমার্কের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল ৷ ১৮৮৭ সালে বিসমার্ক রাশিয়ার সঙ্গে "রি ইন্সুরেন্স চুক্তি" সম্পাদিত করেন ৷ এই চুক্তি দ্বারা রাশিয়া প্রতিশ্রুতি দেয় যে ফ্রান্স জার্মানিকে আক্রমণ করলে রাশিয়া ফ্রান্স কিংবা জার্মানি কোন পক্ষে সমর্থন করবে না নিরপেক্ষ থাকবে ।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে বিসমার্কের সময়ই জার্মানি ইউরোপীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল ৷ তিনি জার্মানির স্বার্থ ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন ৷ তিনি ফ্রান্সকে দীর্ঘদিন ইউরোপের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে শান্তিপূর্ণভাবে জার্মানির রাষ্ট্রীয় সংহতি ও অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করেছিল ৷