চীনের মুক্তদ্বার নীতি Open Door Policy in China
আধুনিক চিনের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক পর্ব হল চিং রাজবংশের শেষ পর্ব। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বৈদেশিক আগ্রাসনের ফলে বিধ্বস্ত ও বিদীর্ণ হয়েছিল এই বিশাল দেশটি। আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলন দেশকে বৈদেশিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারেনি, প্রাদেশিক শাসকরা শক্তিশালী হয়ে উঠে পৃথক পৃথক ক্ষমতার কেন্দ্র গঠন করেছিল। উনিশ শতকের শেষে সম্রাট কোয়াংসু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হন, তাঁকে বন্দি করে রেখে ক্ষমতা ভোগ করেন বিধবা রানি জু-সি। মাকু রাজবংশকে রক্ষার জন্য রানি বক্সারদের মাঞ্চু বিরোধিতাকে বিদেশি বিরোধিতায় রূপান্তরিত করেন। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। দুর্দশা শুরু হয়েছিল জাপানের হাতে চিনের পরাজয় থেকে। চিনের সামরিক দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়েছিল। চিন যে অন্তঃসারশূন্য, ভারসাম্যহীন একটি দেশ একথা বুঝতে বিদেশিদের বেশি দেরি হয়নি। জাপান শিমনোমেকির সন্ধিতে (১৮৯৫) চিনের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণসহ লিয়াওটুং উপদ্বীপ আদায় করে নিয়েছিল। এই চুক্তির অব্যবহিত পরে চিন ব্যবচ্ছেদের আশঙ্কা প্রবল আকারে দেখা দিয়েছিল ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
রাশিয়ার জার সরকার শান্তিপূর্ণভাবে চিনে অনুপ্রবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল (peaceful penetration of China)। রাশিয়া ফ্রান্স ও জার্মানিকে সঙ্গে নিয়ে জাপানকে লিয়াওটুং উপদ্বীপ ফেরত দিতে বাধ্য করেছিল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল রাশিয়া এখানকার লিজ নিতে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠেছিল, শেষপর্যন্ত এই উপদ্বীপটি গ্রাস করেছিল, তার আগে রাশিয়া উত্তরে পোর্ট আর্থার ও ডাইরেন অধিকার করে নিয়েছিল। মাঞ্চুরিয়ার মধ্য দিয়ে রেলপথ স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। জার্মানির দুজন মিশনারি নিহত হলে জার্মানি কিয়াওচাও ও শানটুং অধিকার করে নিয়েছিল। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জাপান পিছিয়ে ছিল না। ইংল্যান্ড নতুন করে ওয়েইহাইওয়েই ও কোলুন অধিকার করে নেয়। সমগ্র ইয়াংসি উপত্যকায় ইংল্যান্ডের প্রাধান্য ছিল। ফুকিয়েন প্রদেশ জাপানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ফ্রান্স কোয়াংটুং, কোয়াংসি ও উনান অঞ্চলে নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিল। চিনে আমেরিকার অল্প বাণিজ্য ছিল, তার মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের মাত্র দুই শতাংশ। চিনের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ছিল ইংল্যান্ডের, মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫৫ মিলিয়ন পাউন্ড, এর ৩৫ মিলিয়ন ছিল ইংল্যান্ডের সঙ্গে। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে স্পেনকে পরাস্ত করে আমেরিকা ফিলিপিন অধিকার করেছিল। চিন সম্পর্কে মার্কিনিদের আগ্রহ বেড়েছিল। চিনে কর্মরত বণিক ও মিশনারিরা সেখানে মার্কিন হস্তক্ষেপ দাবি করেছিল। ব্রিটিশ সরকার চিনের এরকম পরিস্থিতি দেখে ভয় পেয়েছিল, আশঙ্কা করেছিল অন্যান্য দেশের প্রভাবাধীন অঞ্চলে তার বাণিজ্য ক্ষুণ্ণ হবে। ইংল্যান্ড প্রভাবাধীন অঞ্চলের বিরোধী ছিল না। বিরোধী ছিল প্রভাবাধীন অঞ্চলে অন্যের বাণিজ্যিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করার মানসিকতার। ইংল্যান্ড এব্যাপারে আমেরিকার হস্তক্ষেপ দাবি করেছিল।
মুক্তদ্বার নীতির প্রস্তাবনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন চারজন ব্যক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ব্রিটিশ দূত স্যার জুলিয়ান পাউন্সফোট (Pauncefote), ব্রিটিশ অভিজাত লর্ড চার্লস বেরেসফোর্ড (ইনি 'দ্য ব্রেক আপ অফ চায়না' গ্রন্থ লিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনমত গঠন করেন), চিনের শুল্ক বিভাগের ব্রিটিশ অফিসার এ ই হিপিসলে (Hippisley) ও ডব্লিউ, ডব্লিউ, রকহিল। ইনি চিনে মার্কিন দূত হিসেবে কাজ করেছিলেন, হিপিসলের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল। ইনি মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জন হের পূর্ব এশিয়া বিষয়ক পরামর্শদাতা ছিলেন। হিপিসলের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রকহিল যে প্রস্তাবটি পররাষ্ট্র সচিবের জন্য তৈরি করেন তা হল হের ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ সেপ্টেম্বরের প্রথম ঘোষণার সারাংশ। প্রথম ঘোষনায় তিনটি প্রস্তাব ছিল। প্রথম প্রস্তাবে বলা হয় কোনো দেশ চিনের মুক্ত বন্দরের কাজকর্মে হস্তক্ষেপ করবে না, অন্য দেশের কোনো ক্ষতি করবে না। দ্বিতীয় প্রস্তাবে ছিল নিজ প্রভাবাধীন অঞ্চলে কোনো দেশ অন্য দেশের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক বন্দর শুল্ক বা রেলশুদ্ধ আদায় করবে না। তৃতীয় প্রস্তাবের সারাংশ হল প্রভাবাধীন অঞ্চলে চিন সরকারের শুল্ক আদায়ের অধিকার স্বীকার করা হবে। হে এই প্রস্তাব ইংল্যান্ড, জার্মানি, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইতালি ও জাপানের কাছে পাঠিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে চিনে বক্সার বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। হে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে এই সব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনা চালিয়ে ঘোষণা করেন যে মুক্তদ্বার নীতির ক্ষেত্রে এদের কোনো আপত্তি নেই ৷১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ৩ জুলাই জন হে তার দ্বিতীয় নোটে চিনের ব্যবচ্ছেদের আশঙ্কার পটভূমিকায় শান্তি রক্ষা করা এবং আঞ্চলিক ও প্রশাসনিক ঐক্য বজায় রাখার কথা বলেছিলেন। চিনে সব দেশের বাণিজ্যের অধিকার বজায় রাখা হবে । চিন বিদেশিদের যেসব অধিকার দিয়েছে সেগুলি বজায় রাখা হবে ৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনের ক্ষেত্রে কতকগুলি পালনীয় সাধারণ আচরণের কথা বলেছিল, কোনো নতুন নীতি ঘোষণা করেনি ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণায় ভয় পেয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা চিন ব্যবচ্ছেদ থেকে বিরত হয়েছিল একথা ঠিক নয়। আসল কথা হল কোনো একটি দেশের এককভাবে চিন অধিকার করার ক্ষমতা ছিল না, বিদেশি শক্তিগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও রেষারেষি ছিল। এই রেষারেষির জন্য চিং সাম্রাজ্য আপাতত রক্ষা পেয়েছিল। ইংল্যান্ড ও জার্মানি যৌথভাবে চিনের অখণ্ডতা ও মুক্তদ্বার নীতি রক্ষার কথা বলেছিল। ইংল্যান্ড ও জাপান রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্রমশ পরস্পরের কাছে আসতে থাকে। জাঁ শোনো মনে করেন এরা চিনের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় খুব আগ্রহ দেখিয়েছিল তা বলা যায় না। বিদেশিদের প্রভাবাধীন অঞ্চল বজায় রাখার বিরুদ্ধে কোনো ঘোষণা ছিল না। আসলে পূর্ব এশিয়ায় চিন হল একটি বিশাল দেশ, তেতাল্লিশ কোটি মানুষের আবাসস্থল। এই বিশাল বাজার মার্কিন বণিকদের কাছে উন্মুক্ত রাখার জন্য হে এরকম ঘোষণা করেন। উনিশ শতকের শেষে আমেরিকা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না, ইউরোপের সাম্রাজবাদী দেশগুলির সঙ্গে সহযোগিতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঐ দেশের বাণিজ্যের অংশীদার হতে চেয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে যাতে হানাহানি না দেখা দেয় সেকথা মনে রেখেই এইধরনের ঘোষণা তৈরি করা হয়। চিনের সার্বভৌমত্ব বা রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট আগ্রহী ছিল না তার প্রমাণ হল ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে হে নিজেই ফুকিয়েন প্রদেশের উপকূলে সামদা উপসাগরে মার্কিন নৌবহরের জন্য সুবিধা আদায়ের প্রয়াস চালিয়েছিলেন। পূর্ব এশিয়ায় নৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নয়, মার্কিন বণিক ও পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা করা ছিল তার আসল লক্ষ্য।