সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের কারণ ও বৈপ্লবিক কার্যাবলী আলোচনা কর

 সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের কারণ ও বৈপ্লবিক কার্যাবলী আলোচনা কর 


১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা ভারতের মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা ঘটিয়েছিল ৷ কিন্তু প্রতিষ্ঠার প্রথম কুড়ি বছর কংগ্রেস মূলত আবেদন নিবেদনের মাধ্যমে ভারতবর্ষের জাতীয় দাবি দাওয়া আদায়ের সচেষ্টা ছিল কিন্তু এই নরমপন্থী নীতি ভারতবর্ষের দুঃখ দুর্দশা লাথর করতে পারেননি ৷ ফলে ভারতের বুদ্ধিজীবীদের একাংশ কংগ্রেসের কর্মপদ্ধতি সমালোচনার মুখর হয়ে উঠেছিল ৷ তাদের চিন্তাধারা ও মতামত উদারতান্ত্রিক আন্দোলন বিরোধী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করে ৷ এরা অধিকতর জঙ্গি আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকতর দাবি আদায়ের পথ গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন ৷ এই আদর্শ ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চরমপন্থী মতাদর্শ নামে পরিচিত সশস্ত্র বৈপ্লবিক রাজনৈতিক পথ গ্রহণ করে এবং বিপ্লবী কার্যকলাপ শুরু করে ৷ যার সংগ্রাম ছিল জাতীয়তাবাদের রাজনীতি নামে পরিচিত ৷


ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা এই বিপ্লবী আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন নামে অভিহিত করে এর নৈতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বকে বিনষ্ট করতে চেয়েছিলেন ৷ আসলে ঊনবিংশ শতকে নবজাগরণের চেতনা ধর্মীয় সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদী মনোভাব জাগিয়েছিল সেটি কালক্রমে ব্রিটিশ বিরোধী বৈপ্লবিক মনোভাবের সৃষ্টি করেছিল ৷ শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি বৈপ্লবিক সশস্ত্র সংগ্রাম দেশের মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল ৷ ডঃ বিনয় বিহারী মজুমদারের মতে,"The independent of India has been achieved as much my constitutional agitation and non-violet non-cooperation as by militent nationalism." বিপ্লবী যুবকদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল শুধুমাত্র নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ বা স্বদেশী ও পিকেটিং এর দ্বারা ব্রিটিশদের শোষণ বন্ধ করা যাবে না , তাই তারা সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা জোড়পূর্বক দেশে স্বাধীনতা যিনি আনতে বদ্ধপরিকল্পিত হন ।


ভারতীয় সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপের অন্যতম তীর্থভূমি ছিল বাংলা প্রদেশ ৷ পাশ্চাত্য ভাবধারে অগ্রণী বাঙালি যুবকরা বিবেকানন্দ, অরবিন্দ ঘোষ, বঙ্কিমচন্দ্রের দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বৃত্ত হয়ে বিংশ শতকের সূচনায় সশস্ত্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন ৷ শ্রী প্রমথনাথ মিত্র গোপনে স্কটিশ চার্চ ঘরের ব্যায়াম ঘরে অনুশীলন সমিতি নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন এবং যেখানে বঙ্কিমচন্দ্রের অনুশীলন তথ্যের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে যুবকদের নৈতিক চরিত্র ও শরীর গঠনের উপর গুরুত্ব দেন ৷ অরবিন্দ ঘোষ বরোদা থেকে সামরিক শিক্ষা প্রাপ্ত যুবক যতীন বন্দ্যোপাধ্যায় কে বিপ্লবী সংগঠনের জন্য প্রেরণ করেন এবং তিনি অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন । রবিন ঘোষ যুগান্তর পত্রিকার মাধ্যমে বিপ্লবীবাদের প্রচার চালান যার ঘাঁটি ছিল কলকাতা ৷ রবিন ঘোষ এর প্রত্যক্ষ উদ্যোগে নোহাটি রেলস্টেশনের ফুলারের গাড়িতে এবং মেদিনীপুরের বাংলার ছোটলাটের গাড়িতে বোমা নিক্ষেপ হয়েছিল ৷


বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন যখন সক্রিয় কার্য সাধনা করেছিল সেই সময় শ্রী অরবিন্দ ঘোষ জাতীয় বিদ্যালয় অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়ে কলকাতায় এলে বাংলায় বিপ্লবীরা নতুন প্রেরণা লাভ করেন ৷ তিনি বন্দেমাতরম পত্রিকায় গীতার কর্মযোগের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে বিপ্লবীদের অভয় মন্ত্রে দীক্ষিত করেন ৷ এই সময় ঢাকা ও পূর্ববঙ্গের অন্যান্য স্থানে অনুশীলন সমিতির শাখা স্থাপিত হয় ৷ ঢাকা শাখা নেতৃত্বে দেন শ্রীপুলিনবিহারী দাস ‌৷ অনুশীলন সমিতি সারা ভারতব্যাপী একটি বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সংঘটিত করার সুবিন্যস্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন ৷ ১৯১৫ সালে জানুয়ারিতে রামবিহারী বোস, অনুশীলন সমিতির সদস্য নিয়ে বেনারসে সভা করেন ৷ স্থির হয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী বৈপ্লবিক অভ্যতার হবে এই পরিকল্পনা কার্যকর করার দায়িত্বে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ সান্যাল । নগেন্দ্রনাথ দত্ত, অনুকূল চক্রবর্তী প্রমুখ পাঞ্জাবের বিপ্লবীরা সিদ্ধান্ত নেন যে অভ্যুত্থানের সময়ে তারা জাতীয় পতাকা উত্তীর্ণ রাখবেন পতাকাটিতে চারটি রং থাকবে এবং এক একটি রং হবে হিন্দু মুসলিম অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব ৷



তবে চূড়ান্ত মুহূর্তে নেপাল সিং নামে এক ব্যক্তি বিশ্বাসঘাতকতায় সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়, বেনারস ষড়যন্ত্র মামলায় শচীন্দ্রনাথ সান্যাল কে যাবজ্জীবন এবং লাহোরে ষড়যন্ত্র মামলায় ১৪৭ জন বিপ্লবীদের মধ্যে ২৮ জনকে ফাঁসি এবং ২৯ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়, বাকি ৯০ জন কারাদণ্ড পান ৷ রাসবিহারী বসুকে পলাতক বলে ঘোষণা করা হয় সংগ্রামের কর্মসূচি হিসেবে ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকী কিংস ফোর্টকে বোমার আগ হতে হত্যা করতে গিয়ে ভুলবশত দুইজন ব্রিটিশ নাগরিককে হত্যা করে প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেন এবং ক্ষুদিরাম বোসের ফাঁসি হয় ৷ পুলিনবিহারী, অরবিন্দ,বারিন দত্ত, ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেফতার করে আলিপুর ষড়যন্ত্র চালানো হয় ৷ আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাসের চেষ্টায়শ্রী অরবিন্দ মুক্তি পান এবং অন্যান্যদের দ্বীপান্তরিত করা হয় ৷ ঢাকার অনুশীলন সমিতি একইভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যান ৷


অন্যদিকে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়,ডঃ যদু গোপাল , নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রমুখ ও কলকাতার অস্ত্র ব্যবসায় রীড়া কোম্পানির আনীত ১০ কোটি মাউজার পিস্তল হস্তগত করেন জার্মানি থেকে আগত আরো অস্ত্র সংগ্রহের জন্য এরা বালেশ্বরে এসে উপস্থিত হন ৷ কিন্তু ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ হবার তরুণ এদের সাথে ব্রিটিশ পুলিশের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ হন । বুড়িবালামের তীরে সংঘটিত এই যুদ্ধে বাঘাযতীন সহ অনেকে পান দেন ৷ অতঃপর বিপ্লবী কার্যকলাপ বন্ধ ও বিপ্লবীদের দমন করার জন্য সরকার প্রচন্ড দমনন নীতি অবলম্বন করেন ৷ সংশোধন করা হয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় সমস্ত বিপ্লবী সমিতিকে । কিন্তু ইংরেজদের দমন সত্ত্বেও গোপনে বিপ্লবী কার্যকলাপ অব্যাহত থাকে ৷ তবে এই সময়ে ভারতীয় রাজনৈতিক রাজনীতিতে মহাত্মা গান্ধীর আবির্ভাব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে অন্য মাত্রায় প্রদান করেন এবং বিপ্লবী রাও তার দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয় ।

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟