ওয়ারেন হেস্টিং এর সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা কর

 ওয়ারেন হেস্টিং এর সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা কর

 

ওয়ারেন হেস্টিং এর সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা কর


উপনিবেশিক রাজত্বকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকার্যে ভারতের দক্ষ প্রশাসক হিসাবে ওয়ারেন হেস্টিংয়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ৷ ক্লাইভ বাংলাদেশ তথা ভারতের কোম্পানির রাজত্বের যে সূচনা করেছিলেন, দক্ষ প্রশাসক দ্বারা ওয়ারেন হেস্টিং তার সূদৃঢ় ভিত্তি দিয়েছিলেন ৷ ক্লাইভ ও ওয়ারেন হেস্টিং এর মধ্যে তুলনা করে অনেক ঐতিহাসিক নিজেদের মত ব্যক্ত করেছেন ৷ যেমন বিখ্যাত ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার বলেছেন ক্লাইভ বিজিত রাজ্যে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রবর্তনের ব্যর্থ ছিলেন এক্ষেত্রে তার উত্তরাধিকারী অনেক বেশি দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন ৷ আবার ভিনসেন্স স্মিথ মুঘল সম্রাট আকবরের সাথে ওয়ারেন হেস্টিনের তুলনা করে বলেছেন," উভয়ের সংগঠন প্রতিভা ছিল একই এবং উভয়ের মৌলিক নীতিকে কার্যকর করার জন্য অক্লান্ত চেষ্টা চালাতে পারতেন ।"



প্রশাসক হিসাবে দক্ষ হলেও একথা সত্য যে ওয়ারেন হেস্টিংয়ের প্রশাসনের মূল লক্ষ্য ছিল কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা ও বৃদ্ধি করা ৷ হেস্টিং তার রাজত্বকালে উপলব্ধি করেছিলেন যে প্রশাসনকে দক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত করতে না পারলে কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করা যাবেনা ৷ মূলত দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত শাসনের মূল কিছু উদ্দেশ্য পরিলক্ষিত হয় । যেমন (১). কোম্পানির বাণিজ্যিক আয় ও রাজস্ব আদাই বৃদ্ধি করতে (২). কোম্পানির সামাজিক স্বার্থ পূরণ করা এবং (৩). ভারতের আগত ইংরেজ জনগণের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা ৷



ওয়ারেন হেস্টিং এর ভারতে আগমনের পূর্বে ভারতের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সব দিক থেকেই ভারত হয়ে পড়েছিল অচল । প্রথমত পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধ বিপর্যয়ের ফলে বাংলার নবাব প্রশাসন সম্পন্ন ভেঙে পড়েছিল ৷ এর ওপর আবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের ফলে বাংলায় যে দ্বৈত্য শাসন শুরু হয় ৷ এর ফলস্বরূপ বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেখা দেয় ৷ এই দুরবস্থা সুযোগ নেয় কোম্পানির স্বার্থান্বেষী কর্মচারীরা ৷ কোম্পানির অসততার ফলে কোম্পানির আয় কমে যায় ৷ দ্বিতীয়ত, এই সময় দেখা যায় ৭৬ এর মন্বন্তর যা বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করে ৷ এই সময় ওয়ারেন হেস্টিং রেগুলেটিং আইন দ্বারা জারি করেন ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে তাকে গভর্নর জেনারেল আখ্যা দেওয়া হয় ।



গভর্নরের পদে অধিষ্ঠিত হয়ে হেস্টিং প্রথম সংস্কার ছিল প্রশাসনিক সংস্কার । ওয়ারেন হেস্টিং প্রথমেই দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটান ৷ কারণ তিনি এর কুফল সম্পর্কে পূর্বেই অবহত ছিলেন ৷ এর সাথে সাথে তিনি রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সরাসরি কোম্পানির হাতে নেন ৷ তিনি দ্বৈত শাসনের দুই অত্যাচারী নায়ক রেজা খাঁ ও সীতারায় কে পদচ্যুত করেন এবং নবাবের বাৎসরিক ভাতা ৩২ লক্ষ টাকা থেকে ১৬ লক্ষ টাকা কমিয়ে আনেন ৷ সরকারি কোষাগার মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা স্থানান্তরিত করা হয় এবং সদর দপ্তর হিসাবে কলকাতাকে স্থান দেওয়া হয় ।



ওয়ারেন হেস্টিং এর দ্বিতীয় সংস্কার হলো রাজস্ব সংস্কারক রাজস্ব ব্যবস্থায় ন্যায়সংগত ও নিয়ন্ত্রিত করার ভিত্তিতে তিনি বেশ কয়েকটি সংস্কার সাধন করেন ৷ ন্যায় দাবির ভিত্তিতে রাজস্বের পরিমাপ কিছুকালের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়ার লোক নিয়ে হেস্টিং পাঁচশালা বন্দোবস্ত চালু করেন ৷ এই বন্দোবস্ততে স্থির হয় পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হবে ৷ এক্ষেত্রে হোস্টিং এর ভ্রাম্যমান কমিটি গঠন করেন যার কাজ ছিল প্রত্যেক জেলায় হাজির হয়ে জমিদারদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করা ৷ এছাড়াও রাজস্ব বিষয়ে তথ্যাবিধানের জন্য সুপারভাইজার নামক কর্মচারী নিয়োগ করেছিল ৷ এদের নতুন নামকরণ হয় সংগ্রাহক বা কালেক্টর ৷ এরা রাজস্ব আদাই করত কাউন্সিলের দুজন সদস্য এবং তিনজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে নিয়ে গঠিত হয় 'বোর্ড অফ রেভিনিউ' যার কাজ ছিল দেওয়ানি বিষয়ে সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব পালন করা ৷ ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বিহার উড়িষ্যাকে ছয়টি অঞ্চলে ভাগ করে প্রত্যেকটির একটি প্রাদেশিক কাউন্সিলের অধীনে রাখা হয় এবং এদেরকে সাহায্যের জন্য একজন করে ভারতীয় দেওয়ান নিযুক্ত করা হয় ৷ কাউন্সিলের সদস্যদের দুর্নীতি মুক্তির উপায় হিসেবে তিন হাজার টাকা বেতনের ব্যবস্থা করা হয় ৷



হেস্টিং প্রবর্তিত পাঁচশালা বন্দোবস্ত স্থায়ী হলো না ৷ তিনি ভেবেছিলেন যে এই ব্যবস্থার ফলে প্রকৃত জমিদারদের উপকৃত হওয়ার সাথে সাথে কোম্পানির রাজস্ব আদায় সুনিশ্চিত হবে কিন্তু দেখা গেল এই ব্যবস্থার ফলে জমিদারদের বদলে বহু বড় মহাজন জমি বন্দোবস্ত পেয়েছে ৷ কোম্পানির কর্মচারীরাও জমিদারি বৃদ্ধিতে যুক্ত হয়ে পড়েছে ৷ চাষীদের ওপর অত্যাচার বেড়েছে এইসব দেখে হেস্টিং এই ব্যবস্থাকে বাতিল করে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন । তিনি পুনরায় এক বছরের জন্য বন্দোবস্ত চালু করেন যার নাম একশালা বন্দোবস্ত ৷ ভ্রাম্যমান কমিটির দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে তিনি এই কমিটি উঠিয়ে দেন এবং প্রাদেশিক কাউন্সিলের সাধন করে রাজস্ব সংক্রান্ত সমস্ত কর্তৃত্ব রাজস্ব বোর্ডের হাতে অর্পণ করেন ৷ এরপর ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দের রাজস্ব সংক্রান্ত সমস্ত কাজ অনুসন্ধানে তিনি আমিনী কমিশন নামক কমিটি নিযুক্ত করেন ৷



হেস্টিং এর সংস্কারগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরও একটি সংস্কার হল বাণিজ্য সংস্কার ৷ প্রথমত কোম্পানির বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য হেস্টিং দস্তক প্রথা লোপ করেন ৷ ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ফল স্বরূপ কোম্পানির কর্মচারী ও এজেন্টের অবৈধ বাণিজ্য করা সম্ভাবনা হ্রাস পায় । তিনি অন্যান্য দ্রব্যের বাণিজ্য সকলের নিকট উন্মুক্ত রেখে কেবলমাত্র লবণ,সুপারি ও তামাকের উপর কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার রাখেন ৷ দ্বিতীয়ত, সমস্ত প্রদেশে দ্রব্য চালান সহজ করার জন্য ওয়ারিং হেস্টিং শুধুমাত্র দুটি শুলকো ঘাঁটি মুর্শিদাবাদ হুগলী কলকাতা পাটনা ঢাকা বজায় রেখে জমিদারদের নিজস্ব শুল্ক ঘাঁটি গুলি বন্ধ করে দেন ৷ তাদের ওপর যাতে অত্যাচার না হয় সে বিষয়ে তিনি কঠোর নির্দেশ জারি করেন বা নিজের উন্নতির জন্য ভুটান ও তিব্বতে জর্জ বগলের নেতৃত্বে বাণিজ্য প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন ৷



প্রবর্তিত বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার দুর্নীতি দূর করে বিচার ব্যবস্থাকে সুস্থ ও ন্যায় সঙ্গত করার জন্য ফেসটিক বিশেষ মনোযোগী ছিলেন প্রচলিত দ্বৈত শাসনের ফলে বিচার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল । তৎকালীন রীতি অনুযায়ী রাজস্ব ও বিচার বিভাগ পরস্পর মুক্ত হওয়ার ফলে ফৌজদারি বিচার পরিচালনার দায়িত্ব ছিল নবাবের উপর ৷ কিন্তু নবাব নামমাত্র শাসক হওয়া দরুন নিজের কার্য সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেনি । যার ফলস্বরূপ অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো বিচারবিভাগ ভেঙে পড়েছিল ৷ কোম্পানির বাণিজ্যিক তথা আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বার্থসিদ্ধ করার জন্য প্রথমে দুর্নীতি রোধ করতে হবে আর এই দুর্নীতি রোধ করার জন্য বিচার বিভাগকে পুনর্গঠন করা একান্তই প্রয়োজন ৷ তাই তিনি মুঘল আমলের জটিল বিচার পদ্ধতির পরিহার করে ইউরোপের আধুনিক বিচার ব্যবস্থার প্রণয়নের উদ্যোগী হন ।



ওয়ারিং হেস্টিং শুধুমাত্র বিচার ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে থেমে থাকেননি ৷ এই বিচার বিভাগকেও বিকেন্দ্রীকরণের জন্যও তিনি সচেষ্ট ছিলেন তিনি সমগ্র বাংলাকে ৩৫ টি জেলায় বিভক্ত করেন ৷ প্রতিটি জেলায় দেওয়ানী ও ফৌজদারি বিচার সর্বনিম্ন ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হয় এছাড়াও প্রতিটি জেলায় একটি করে মফঃস্বল দেওয়ানী আদালত ও মফঃস্বল ফৌজদারি আদালত স্থাপন করা হয় । হিন্দু আইনবিধি সংকলন করা হয় । জেলা ফৌজদারি আদালতে কাজী ও মুক্তিগণ বিচার পরিচালনা করতেন উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণসহ ফৌজদারি বিচার পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা কালেক্টর গণ তত্ত্বাবধান করতেন । এর উপরে ছিল 'সদর দেওয়ানী আদালত' ও 'সদর নিজামত আদালত' এই বিচারালয় দুটি যথাক্রমে কলকাতার ও মুর্শিদাবাদের স্থাপিত ছিল ৷ আদালত গুলির মধ্যে সবথেকে শ্রেষ্ঠ ছিলেন সদর দেওয়ানী ও সদর নিজাম সহ আদালত কারো প্রাণদন্ড কার্যকর করা থেকে শুরু করে কোন সিদ্ধান্তকে বাতিল করার অধিকার ছিল উচ্চ আদালতেরই ৷ এই আদালতের কার্যকর্মের ওপর নজর রাখতেন গভর্নর জেনারেল ও তার কাউন্সিল ৷



হেস্টিং এর শাসনকালে বিচার বিভাগে কয়েকটি নিয়ম চালু হয় ৷ তার নির্দেশের সত্যকে আদালতে মুকাদ্দাম সংক্রান্ত নথিপত্র রচনা ব্যবস্থা পরিবর্তন হয় ৷ নিয়ম করা হয় যে ঘটনার 12 বছরের মধ্যে মামলার রজ্জু না করলে তা তামাদি হয়ে যাবে ৷ সুদের হার নিয়ন্ত্রিত রাখার প্রচলিত সরকারি নজরদারি বৃদ্ধি করা হয় ৷ বিচারের ক্ষেত্রে হেস্টিংয়ের বড় অবদান হলো যে তিনি আইনের চোখে সকলকে সম অধিকারে তথ্য প্রতিষ্ঠার করতে প্রয়োগী ছিলেন এবং বিচারব্যবস্থাকে কাজীর মধ্যে নির্ভরশীল না রেখে তাকে কিছুটা ন্যায়ানুক ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সশস্ত্র হয়েছিলেন ৷



উপরীয়ক্ত আলোচনা থেকে জানা গেল ওয়ারেন হেস্টিং বাংলার অনেক সংস্কার প্রবর্তন করেছিলেন কিন্তু এসব গুলি ছিল প্রত্যক্ষভাবে নিজেদের অর্থাৎ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্বার্থসিদ্ধির জন্য ৷ এই সংস্কারের পরোক্ষভাবে বাংলার উন্নতির চিত্র দেখালেও বাংলায় সঠিক উন্নতি হয়নি ৷ আবারও হেস্টিং এর সংস্কার প্রবর্তনের ফলে যে বাংলার একদমই উন্নতি হয়নি তা বলা যায় না ৷ কারণ এই সংস্কারের ফলে বাংলার মানুষজনদের জীবনযাত্রা কিছুটা হলেও নিয়মাবীতিতে সীমাবদ্ধ হয়েছিল ৷ পরিশেষে বলা যায় বাংলায় ওয়ারিং হেস্টিনের অবদান অনস্বীকার্য ৷



তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ওয়ারেন হেস্টিং এর সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা কর এই নোটটি পড়ার জন্য

About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟