ভারতের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈকি জীবনে ভারত বিভাজছেন প্রভাব আলোচনা করো।
অর্থনৈতিক জীবনে ভারত বিভাজনের প্রভাবঃ ভারতবর্ষ যতদিন রিটশার অধীনস্থ উপনিবেশ ছিল ততদিন ব্রিটিশ সরকার ভারতকে অর্থনৈতিক দিক থেকে শোষণ করেছিল। সেজন্য স্বাধীনতার পূর্বে ভারতের অর্থনীতিতে এক স্থাবর অবস্থা ছিল রাস্তাঘাট, শিক্ষা এবং অন্যান্য পরিকাঠামোমূলক ব্যবস্থায় কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি লক্ষ্য করা যায় নি। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতালাভের সময় ভারতের অর্থনীতি গ্রামীণ এবং কৃষিভিত্তিক ছিল।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে ও পরে ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ৮৫৭% জনগণ গ্রামেই বসবাস করতো এবং কৃষির উপর নির্ভর করে তাদের জীবন অতিবাহিত করত। অধিক উৎপাদনের জন্য কৃষিতে উন্নত রাসায়নিক সারের ব্যবহার ছিল না বললেই চলে। কুটীর ও ক্ষুদ্রায়তন শিল্পে সমগ্র জনসংখ্যার এক-দশমাংশ নিযুক্ত ছিল। ম্যালেরিয়া, বসন্ত, কলেরা, দুর্ভিক্ষ, অজন্মা ভারতের অর্থনীতিকে পঙ্গু করেছিল। শতকরা ৮৪জন জনগণ অশিক্ষিত ও নিরক্ষর ছিল। মরণশীলতার হার ছিল প্রতি হাজারে ২৭জন।
কৃষিমন্ত্রক খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সেচ ব্যবস্থার উন্নতির লক্ষো পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। দামোদর উপত্যকা পরিকল্পনা (DVC), ভাকরা-নাঙ্গাল বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গৃহীত হয়েছিল। শিল্পের উন্নতির জন্য রাসায়নিক সার প্রকল্প, কাগজমুদ্রণ শিল্পের উন্নতি, রেলইঞ্জিন নির্মাণ, লৌহ ও ইস্পাত শিল্প, টেলিফোনের যন্ত্রপাতি নির্মাণ প্রকল্প গৃহীত হয়। ১৯৪৮ খ্রিঃ বৈদেশিক মুদ্রার ভারসাম্য ভারতের অনুকূলে ছিল।
ভারত ব্যবচ্ছেদের ফলে মুদ্রাস্ফীতি এক বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের অভাব দেখা দিয়েছিল। ভারত বিভাগের পর উদ্বাস্তু সমস্যা ও সাম্প্রদায়িক ঘটনার বৃদ্ধি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছিল। তবে এ ব্যাপারে উন্নতির জন্য স্বাধীন ভারতের সরকার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। এই সময় ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশন এক গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হিসাবে গড়ে ওঠে। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী জন ম্যাথাই পরিকল্পনা কমিশনকে একটি শাসনতন্ত্র বহির্ভূত সংস্থা হিসাবে মনে করতেন এবং এজন্য তিনি পদত্যাগ করেন। তথাপি একথা অনস্বীকার্য যে স্বাধীনতার পর পরিকল্পনা কমিশন ভারতের অর্থনীতি ও অন্যান্য বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল।
সমাজ-জীবনে ভারত বিভাজনের প্রভাবঃ
ভারত বিভাজনের ফলে ভারতীয় সমাজে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিল সাম্প্রদায়িক সমস্যা। দেশ বিভাগের ফলে প্রায় যাট লক্ষ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল। তারা ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই সংখ্যালঘুদের উপর অমানবিক অত্যাচার শুরু হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ সংখ্যালঘু নিহত হয়েছিল। দিল্লী, পাঞ্জাব, বাংলা, বিহার প্রভৃতি অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। এর ফলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বিপন্ন হয়েছিল।
১৯৪৭ খ্রিঃ সেপ্টেম্বরে দিল্লীর পথে সেনা নামানো হয়েছিল। পুলিশকে কঠোরভাবে এই দাঙ্গা দমনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তার ফলে সাম্প্রদায়িক সমস্যা অচিরেই নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফাইল অচিতে সরকার প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে সভ্যতা ও স্বাধীনতা বিপন্নদাই সমস্যাকে সমাধান করতে সক্ষম হয়েছিল। সরকার ভারতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হয়েছিল। তার ফলে প্রায় সাড়ে চার কোটি মুসলমান ভারতে রয়ে গিয়েছিল।
তবুও জাতির জনক মহাত্মাগান্ধী সাম্প্রদায়িকতার কাছে নিজের জীবন দিয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার ব্যাপারে গান্ধীজী দুঃখ করে বলেছিলেন, তিনি ঈশ্বরকে জানিয়েছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিশ্বস্ত ভারতের 'অশ্রু প্লাবিত ভূমি' থেকে তাঁকে তুলে নিতে। ১৯৪৮ সালে ৩০ জানুয়ারী গান্ধীজী এক উগ্র হিন্দুবাদী নাথুরাম গডসের হাতে নিহত হন। গান্ধীজীর শহীদ হওয়ার ঘটনা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে একটি বড় ধাক্কা দিয়েছিল। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা মোকাবিলার একমাত্র পথ বলে স্বীকৃত হয়েছে।
ভারত বিভাজনের দ্বিতীয় প্রভাব ছিল ছিন্নমূল পরিবারবর্গের আশ্রয়ের সমস্যার সমাধান করা। ভারত বিভাগের ফলে প্রায় ষাট লক্ষ ভারতবাসীকে গৃহহারা হতে হয়েছিল। তাদের ত্রানের ব্যবস্থা এবং পুনর্বাসনের সমস্যা স্বাধীন ভারতকে বিব্রত করেছিল। স্বাধীন সরকারকে সর্বশক্তি নিয়ে এই সমস্যার সমাধানে নামতে হয়েছিল। এই সমস্যার সমাধান করতে যথেষ্ট সময় লেগেছিল। তবে ১৯৫১ খ্রিঃ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান মোটামুটিভাবে নিষ্পত্তি হয়েছিল।
ভারত বিভাগের ফলে হিন্দুরা পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানে নিরাপত্তার অভাববোধে ভুগছিলেন। হিন্দুদের উপর দৈহিক অত্যাচার বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯৪৬ এবং ১৯৫০ খ্রিঃ দাঙ্গার ফলে প্রায় দু-লক্ষ হিন্দু বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবাংলায় আশ্রয় নিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পশ্চিম বাংলায় এসেছিলেন। পশ্চিমবাংলার পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা সত্যিই কঠিন ছিল। তবে শেষপর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় এবং ভারত সরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়েছিল। তথাপি পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলায় অনুপ্রবেশ আজও বন্ধ করা যায় নি। ১৯৭১ খ্রিঃ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বহু অসহায় হিন্দু পশ্চিমবাংলায় আশ্রয় নেয়। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই সমস্যার সমাধান অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করেন।
রাজনৈতিক জীবনে ভারত বিভাজনের প্রভাবঃ
স্বাধীনতা লাভের পর ভারতকে বেশ জটিল কয়েকটি রাজনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। লক্ষা লক্ষ্য নরনারীর স্বার্থত্যাগ এবং ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এই স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে সহায়তা করেছিল। স্বাধীনতার পর ভারতকে অজস্র সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এজন্য পন্ডিত নেহেরু নিজেই বলেছিলেন- 'যে সাফল্যের জন্য আমরা উৎসব করছি তা কিন্তু নিছক একটি ধাপ, একটা সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাওয়ার মাত্র।'
প্রথমতঃ স্বাধীনতার পরেই যে সমস্যাটি সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হলো দেশীয় করদ রাজ্যগুলিকে ভারত ইউনিয়নের সাথে যোগ করা।
দ্বিতীয়তঃ দেশ ভাগের সাথে সাথে সাম্প্রদায়িক সমস্যা নগ্ন আকারে দেখা দিয়েছিল। তার আশু মোকাবিলা করার প্রয়োজন ছিল। পাকিস্তান থেকে আগত প্রায় যাট লক্ষ্য উদ্বাস্তুর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। সাম্প্রদায়িক গুণ্ডাবাজদের আক্রমণ থেকে মুসলমান ও হিন্দুদের রক্ষার প্রয়োজন দেখা দেয়।
তৃতীয়তঃ স্বাধীন ভারতের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনা করা অন্যতম সমস্যা ছিল। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র এবং নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রে ও রাজ্যগুলিতে সরকার গঠন করা, সবশেষে ভারতে ভূমি ও ভূমি-রাজস্ব প্রশাসনে যে 'আধা সামন্ততান্ত্রিক' বাবস্থা প্রচলিত ছিল তার অবসান ঘটানো।