১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলনের পটভূমি ও গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতা বিশদভাবে আলোচনা করো।
অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। ১৯২৭ খ্রিঃ সাইমন কমিশনের নিয়োগের পর পুনরায় দেশজুড়ে ব্রিটিশ-বিরোধী অংন্দালন শুরু হয়। এরই ফলশ্রুতিতে শুর হয় গান্ধিজীর নেতৃত্বে বৃহৎ গণ-আন্দোলন হিসাবে আইন অমান্য আন্দোলন।
সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ভারতকেও স্পর্শ করা, শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপকতা এবং সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের পটভূমিকায় ১৯২৮ খ্রিঃ কলকাতা অধিবেশনে জাতীয় কংগ্রেস ঘোষণা করে এক বছরের মধ্যে ব্রিটিশ সরকার নেহরু রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতকে ডোমিনিয়ন স্টেটাসের মর্যাদা না দিলে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি গ্রহণ করা হবে। কিন্তু সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহন না করায় ১৯২৯ খ্রিঃ লাহোর কংগ্রেসে পূর্ণ স্বরাজের দাবি গৃহীত হয়। ১৯৩০ খ্রিঃ জানুয়ারীতে গান্ধিজী ইয়ং-ইন্ডিয়া পত্রিকায় ১১ দফা দাবী পেশ করেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তাতে কর্ণপাত না করায় কংগ্রেস কার্যনির্বাহী সমিতি গুজরাটের সবরমতী আশ্রমে এক সম্মেলনে গান্ধিজীর নেতৃত্বে অহিংস আইন অমান্য আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত ঘোষনা করে।
গান্ধিজি আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করতে প্রথমেই লবণ আইন ভঙ্গ করা সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় ভারতীয়দের লম্বদ। তৈরী করা ছিল আইনত দন্ডনীয়। ১৯৩০ খ্রিঃ ১২ মার্চ গান্ধিজী তাঁর ৭৮০ জন বিশ্বর সত্যাগ্রহীকে নিয়ে সবরমতী আশ্রম থেকে ২৪০ মাইল দূরে অবস্থিত গুজরাটের সমুদ্রোকূলের ডান্ডি নামক স্থান অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। ৫ এপ্রিল তারা ডান্ডিতে পৌঁছান। পরদিন গান্ধিজি নিজের হাতে সমুদ্রের জল থেকে লবণ তৈরি করে লবণ আইন ভঙ্গ করেন।
ক্রমে সারা ভারত জুড়ে এই আন্দোলনের দ্রুত প্রসার ঘটে। সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিতে অঞ্চলগুলিতে লবণ আইন ভঙ্গ করা হতে থাকে। এ ছাড়া অন্যান্য স্থানে নিষিদ্ধ প্রচার পুস্তিকা বিক্রি করা, বিলাতি দোকানে পিকেটিং করা, ১৪৪ ধারা অমান্য করে সভা-সমিতি করা প্রভৃতি বিভিন্নভাবে আইন অমান্য করা হয়।
গান্ধিজির আহ্বানে মহিলারাও দলে দলে আইন অমান্য আন্দোলনে সামিল হয়। উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, বাংলার মেদিনীপুর প্রভৃতি স্থানে কৃষকরা ভূমিরাজস্ব দেওয়া বন্ধ করে। প্রায় সারা ভারত জুড়ে ব্যাপকভাবে এই আন্দোলনে পরিচালিত হয়। ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন সীমান্ত গান্ধি বা খান আবদুল গফফর খান। তাঁর প্রতিষ্ঠিত 'খোদা-ই-খিদমৎগার' (ঈশ্বরের সেবক) বা লালকোর্তা বাহিনীর সদস্যরা সম্পূর্ণ অহিংসভাবে ইংরেজদের প্রবল দমননীতি সত্ত্বেও আইন অমান্য আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন।
গুজরাটের সুরাটের কাছে ধরসানায় গান্ধিজি সরকারি লবণ গোলা দখল করতে চাইলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর অনুপস্থিতিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন সরোজিনী নাইডু। তাঁর সাথে ছিলেন কমলা নেহরু, বাসন্তীদেবী প্রমুখরা। আইন অমান্য আন্দোলনের তীব্রতা যত বাড়তে থাকে ইংরেজ সরকারের অত্যাচারের মাত্রাও তত বাড়তে থাকে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার ও গুলি করা হয়। শতাধিক সত্যাগ্রহী মৃত্যুবরণ করেন। প্রায় একলক্ষ সত্যাগ্রহীকে কাররুদ্ধ কর হয়।
কঠোর দমননীতি প্রয়োগ করেও আন্দোলনের তীব্রতা না কমায় সরকার সরকার তখন আলোচনার পথে অগ্রসর হলেন। প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেস যোগ না দেওয়ায় এই বৈঠক ব্যর্থ হয়। বড়লাট লর্ড আরউইন গান্ধিজির সাথে ১৯৩১ সালে একটি চুক্তি করেন। ইহা গান্ধি-আরউইন চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তি অনুযায়ী আন্দোলন আপাতত স্থগতি থাকে এবং কংগ্রেস দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেয়। এ ছাড়া এই চুক্তি অনুযায়ী রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়ার এবং লবণ তৈরীর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা বলা হয়।
গান্ধিলী দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক থেকে শূন্য হাতে ফিরে এসে দ্বিতীয় বার আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন। সরকার এবার আরো কঠোর দমননীতি প্রয়োগ করতে থাকে। তাহ্য সত্ত্বেও আন্দোলনের গতি কম না হওয়ায়।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ড 'সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা' নীতি ঘোষনা করে ভারতের জাতীয় ঐক্যকে বিনষ্ট করার চেষ্টা করেন। সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির বিরুদ্ধে গান্ধিজি পুনার খারবেদা জেলে অনশন শুরু করেন। এই পরিস্থিতিতে অনুন্নত সম্প্রদায়ের নেতা ড. বি আর আম্বেদকর গান্ধিজির সাথে পুনা চুক্তি করেন। এই চুক্তি দ্বারা হিন্দু সমাজের বিভাজনকে রক্ষা করা হয়। এরপর আন্দোলনের তীব্রতা হ্রাস পায়। শেষপর্যন্ত ১৯৩৪ খ্রিঃ কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করেন।
আইন অমান্য আন্দোলনের গুরুত্বঃ
প্রথমতঃ দেশের সর্বস্তরের মানুষ অকুতোভয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহী সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করে।
দ্বিতীয়তঃ নারীদের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ধনী- দরিদ্র, শহুরে-গ্রাম্য, কৃষক-শ্রমিক সকল শ্রেণীর ভারতীয় নারী এই আন্দোলনে পুলিশের হাজারো অত্যাচার অগ্রাহ্য করে সত্যাগ্রহ করেন।
তৃতীয়তঃ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত সকল শ্রেণির মানুষ প্রবল উৎসাহে এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এভাবে কংগ্রেসের আন্দোলন একটা জাতীয় রূপ গ্রহণ করে।
চতুর্থতঃ এই আন্দোলনের ফলে ভারতীয়দের মধ্যে যে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হয়েছিল তা ভবিষ্যতের সফল সংগ্রামের সোপান রচনা করেছিল।
পঞ্চমতঃ এই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ভারতের জাতীয় সমস্যা আন্তর্জাতিক সমস্যায় রূপান্তরিত হয়।
আইন অমান্য আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা বা ব্যর্থতাঃ
আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা থেকেই গ্রেফতার, লাঠিচার্জ, জরিমানা, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, বেত্রাঘাত করা এমনকি গুলি-গোলাও চালানো হতে থাকে। কেবলমাত্র পেশোয়ারে পুলিশের গুলিতে লালকোর্তা বাহিনীর ৩০০ জন সত্যাগ্রহীর মৃত্যু হয়েছিল। প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার সত্যাগ্রহীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এই তীব্র দমননীতি সহ্য করে জনগণের পক্ষে আন্দোলন পরিচালনা করা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল।
আন্দোলনকে সুদীর্ঘ দিন পরিচালনা করার জন্য যে সাংগাঠনিক শক্তির প্রয়োজন, কংগ্রেসের তা ছিল না। এই সাংগাঠনিক দুর্বলতার কারনে আন্দোলন কোনো সুসংহত রূপ গ্রহণ করতে পারে নি। আন্দোলন পরিচালনার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। 'তিলক স্মৃতি তহবিল'-এর সাথে কোনো তহবিল গঠন করা হয়নি। পুঁজিপতিরাও অর্থ সাহায্যে কার্পন্য করেছিল। কমিউনিস্টদের আন্দোলন বিমুখীনতাঃ কমিউনিস্টরা এই আন্দোলন মেনে দেশ মুক্তির জন্য যতটা সচেষ্ট স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি ছিল ঠিক ততটাই উদাসীন।
এই আন্দোলনে সাধারণভাবে সর্বশক্তিদিয়ে তাঅংশ নেয়নি। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও আর কিছু স্থান ছাড়া অন্যান্য জায়গায় মুসলিমরা এই আন্দোলনের প্রতি অনাগ্রহী ছিল। গান্ধিজী এই আন্দোলন পরিচালনার জন্য কোনো প্রকার পরিকল্পনা বা কর্মসূচির ঘোষণা করেন নি। অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হওয়ায় ব্রিটিশদের পক্ষে আন্দোলন দমন করা সহজ হয়। ১৯৩০ খ্রিঃ এই আন্দোলন বার্থতা সত্ত্বেও এর ঐতিহাসিক কীর্তি, গভীর শিক্ষা ও অপরিসীম স্থায়ী ফলাফলের কথাকে অস্বীকার করা যায় না