দলিত আন্দোলন বলতে কী বোঝো? দলিত আন্দোলনে আম্বেদকরের উদ্দেশ্য ও ভূমিকা আলোচনা করো।
দলিত কথার নিম্নবর্গীয় অর্থ শূদ্র তথা হরিজন তথা অস্পৃশ্য জাতি। দলিত আন্দোলন হল নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দলিত, অস্পৃশ্য, লাঞ্ছিত, অপমানিত মানুষদের জাতপাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
জ্যোতিরাও ফুলে যে বঞ্চনাহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চেষ্টা করেন তাঁরই অনুগামী বাবাসাহেব ভীমরাও রামজি আম্বেদকর। মানব-কল্যাণে জ্যোতিবা ফুলের মহান কর্মকান্ডের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দলিত আন্দোলনকে তিনি আরও শক্তিশালী ও ও গতিশীল করে তোলেন। জ্যোতিবা ফুলের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন যে, আদর্শ সমাজের ভিত্তি হবে স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ববোধ, মানুষের মর্যাদা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও মূল্যবোধ। এরূপ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে পুরানো জাতপাতের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজকে ভেঙে ফেলতে হবে।
দলিতদের প্রতি পুরানো সমাজের অমানবিক ব্যবহারের চিত্র আম্বেদকরর দক্ষ শিল্পীর মতো ফুটিয়ে তুলেছেন। মহারাষ্ট্রে পেশোয়ারের রাজত্বকালে বর্ণহিন্দুরা যখন রাজপথে বার হত, তখন সেই পথ অস্পৃশ্যদের ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হত না। পরিচিতি ব্যবহার করার জন্য অস্পৃশাদের কালো সুতো গলায় বা হাতে পরতে হতো। অস্পৃশ্য হওয়ার অপরাধে ডাক্তাররা হরিজনদের চিকিৎসা করতেন না। দলিত ও অস্পৃশ্যদের কুয়ো থেকে জল তুলতে দেওয়া হত না। দলিতদের মৃতদেহ শশ্মশানে দাহ করা যেত না। বাবাসাহেব আম্বেদকর এই সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলন 'দলিত আন্দোলন' নামে পরিচিত।
দলিত আন্দোলনের স্তরবিন্যাসঃ
এই দলিত আন্দোলনকে দুটি স্তরে ভাগ করা যায়। -দরখাস্ত ও প্রতিবাদের স্তর এবং প্রত্যক্ষ সংগ্রামের স্তর ১৯০৬ সালে তৎকালীন বিশিষ্ট সমাজসেবী এস কে বোলের নেতৃত্বে দলিতদের আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন ছিল সাধারণ জলাশয়, কুয়ো, যাতায়াতের পথ, সরকারি বিদ্যালয়, আদালত, যানবাহন ইত্যাদিতে দলিত ও অস্পৃশ্যদের ব্যবহার করার সমান অধিকার দেবার দাবিতে আন্দোলন। ১৯২৬ সালে ব্রিটিশ সরকার দলিতদের দাবি মেনে নেয় ও আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু বর্ণহিন্দুদের বিরোধীতায় দলিতরা এই অধিকার বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। তারা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম
শুরু করেন কটি জনপথকে কেন্দ্র করে প্রথম সংগ্রাম শুরু হয়। এই স্থানটি চির সেকালের ত্রিবায়ুর রাজ্য। এই রাজোর ভেইকম মন্দিরের প্রবেশপন রাফের সেকালের, ব্রিজমীন ছিল। অথচ দলিতদের ওই পথ ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। দলিতর রক্ষনাবেক্ষণের করে। শেষ পর্যন্ত দলিতদের যাতায়াতের জন্য অন্য পথ নির্মাণ কর হয়। আম্বেদকর অনুগামীদের নিয়ে এই পথ দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করেন এর সাধারণ জলাধার থেকে জলপান করেন।
দ্বিতীয় সংগ্রাম শুরু হয় মুম্বাই পুরসভার অন্তর্গত কোলাবা জেলার মাহম শহরের একটি পুকুরকে কেন্দ্র করে। পুকুরটির নাম চৌদাপুকুর, যার রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্ব ছিল মাহাদ পুরসভার। ১৯২৬ সালে ওই পুকুরের জল ব্যবহারের আইনগত অধিকার দলিতদের দেওয়া হলেও স্থানীয় বর্ণহিন্দরা সেটি ব্যবহার করতে দিত না আম্বেদকরের নেতৃত্বে জনতা চৌদার জলাধার স্পর্শ করে জলপান করে। এতে বর্ণহিন্দুরা ক্ষিপ্ত হয়ে অস্পৃশাদের ওপর নৃশংসতা চালায়। অস্পৃশ্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে সম্মেলনের ডাক দেয়। এই বিষয়ে আদালতের চূড়ান্ত রায় অস্পৃশ্যদের পক্ষে যায়।
ক্রমশ আম্বেডকরের নেতৃত্বে দলিত আন্দোলন আরও তীব্র হয়। সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পথ হিসাবে দলিতরা হিন্দুদের মৃত গবাদি পশু বহন কর থেকে বিরত থাকে। অন্যদিকে বাবাসাহেবের নেতৃত্বে দলিতরা 'মনুস্মৃতি' পোড়াতে থাকে। দলিতদের মন থেকে ধর্মীয় কু-সংস্কার দূর করার জন্য আম্বেডকর বলেছিলন 'আইন মনুর আজ্ঞামতো নীচ জাতির মানুষকে অপমান করে, তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং তাদের বাক্তিত্বকে বিনাশ করে। অতএব, 'মনুস্মৃতি' পোড়ানে দরকার।
আম্বেদকর বুঝতে পারেন কেবল বর্ণহিন্দুদের সামাজিক বয়কট করলে দলিতদের সামাজিক মুক্তি আসবে না। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক আন্দোলনের, চাই রাজনৈতিক অধিকার, দলিত ও অস্পৃশ্যদের সামাজিক অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি। ত্রিশের দশক থেকেই গণতান্ত্রিক কাঠামোয় ভারতীয় সংবিধান প্রস্তুতির উদ্যোগ শুরু হয়। ১৯২৮ সালে ব্রিটিশ সরকার সাত-সদস্য বিশিষ্ট 'সাইমন- কমিশন' গঠন করে ভারতে পাঠায়।
আম্বেদকর একটি স্বতন্ত্র প্রতিবেদন সাইমন কমিশনে পেশ করেন। প্রতিবেদনে দেশের ঐক্য ও প্রগতি বজায় রাখার জন্য দলিত শ্রেণীকে একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায়। হিসাবে স্বীকার করা দাবি পেশ করেন। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত সাইমন কমিশনে প্রতিবেদনে দলিতদের প্রতিনিধিত্বের কথা স্বীকার করা হয়। এভাবে ধাপে ধাপে দলিত ও অস্পৃশ্যদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে আম্বেডকর এগিয়ে গেছেন। আম্বেডকরের। এই আন্দোলন সমাজের দুর্বলতর শ্রেণির জীবনের গুণগত মানে অসাধারণ প্রভাব ফেলেছে ৷
জাত-পাতের ভিত্তিতে মানুষের সাথে মানুষের বিভাজন শতবর্ষ পরেও মুছে যায়নি। দলিত-পতিত মানুষদের ওপর উচ্চবর্ণের নিয়াহ, লাঞ্ছনা, প্রহার বা হত্যালীলা আজও সংঘটিত হয়। একসময়ে তামিলনাডুতে দলিতদের ছায়া মাড়ালে ব্রাহ্মণদের স্নান করতে হতো বলে নিম্নবর্গীয়দের গলায় ঘন্টা বেঁধে পথ চলতে হত যাতে উচ্চবর্গীয়রা দলিত সংগ্ৰৰ এড়িয়ে চলতে পারে। আজও তামিলনাডুতে দলিতদের চা-পানের গ্লাস দোকানে আলাদা করে রাখা হয়।
আশার কথা হল আজ দেশের আইন সরব। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছেন যে, দলিতদের শারীরিক বা মানসিক-জাত তুলে কটুক্তি করা বা সেই কারণে যথেচ্ছ মারধর করা কেবল আইনগত অপরাধ নয়, সামন্ততান্ত্রিক বর্বরাতাও, যার কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু কেবল আইন করে এই রোগের নিরাময় সম্ভব নয়, এজন্য প্রয়োজন জনগনের মানসিক পরিবর্তন। এজন্য চাই শিক্ষার বিস্তার, আম্বেদকরের সংস্কার আন্দোলন।