মুঘল যুগের ইতিহাসের উপাদান হিসাবে বিদেশি পর্যটকদের বিবরণের গুরুত্ব আলোচনা করো?
বাবরের হাত ধরে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ বিজয়ের মাধ্যমে ভারতে মুঘল শাসনের সূচনা হয়। পরবর্তী প্রায় ২০০বছর ধরে ৬জন বিশিষ্ট মুঘল সম্রাট মিলে ভারত শাসন করেন । ফলে ভারতের মাটিতে মুঘলদের একটা দীর্ঘ ইতিহাস রচিত হয় । বর্তমানকালে যদি কোন পাঠক বর্গ সেই ইতিহাস জানতে চায় তাহলে তাকে মুঘল যুগের ইতিহাসের বেশ কয়েকটি উপাদানের উপর নির্ভর। করতে হয়। যেমন- (ক) সাহিত্য, (খ) সরকারি নথিপত্র, ফরমান ও চিঠিপত্র, (গ) ইউরোপীয় ভ্রমণকারীদের বিবরণ ও বাণিজ্যকুঠির নথিপত্র এবং (ঘ) মুদ্রা ও শিল্প-নিদর্শন প্রভৃতি। উপরের এই সমস্ত উপাদান গুলির মধ্যে অন্যতম একটি হলো- মুঘল আমলে আগত বিভিন্ন বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ।
মুঘল যুগে ভ্রমণ পিপাসু একাধিক ইউরোপীয়রা ব্যাপকভাবে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। কেউ এসেছেন ব্যবসা করতে, কেউবা এসেছিলেন ভারত ভ্রমণে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই রেখে গেছেন তাঁদের ভারত ভ্রমণের লিখিত বিবরণ। এসব বিবরণে মুঘল যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক অবস্থার এক তথ্যবহুল চিত্র পাওয়া যায়। স্বভাবতই বিদেশী বণিক ও পর্যটকদের এসব লিখিত বিবরণ সে যুগের ঐতিহাসিক দলিল। এঁরা যা দেখেছেন বা শুনেছেন তা লিখেছেন। ফলে এসব বিবরণীতে বহু ত্রুটিও লক্ষ্য করা যায়। তথাপি মুঘল যুগের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে এসবের ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।
ফাদার মনসারেটের রচনা মোঙ্গোলিকা লিগেশিয়নিস কমেন্টারিস ১৫৮০ খ্রীঃ রচিত হয়। আকবরের ইতিহাস রচনার জন্যে মনসারেটের রচনা মূল্যবান উপাদান। আকবরের রাজত্ব কালের মাঝামাঝি সময়কালে (১৫৮৩-১৫৯১) রালফ ফিচ্ ভারতবর্ষে এসেছিলেন। তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়ান। তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে ভারতের বিভিন্ন খাদ্যশস্য, সুতীবস্ত্র এবং জনজীবনের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর প্রাচুর্যের কথা তিনি তুলে ধরেছেন। তিনি দিউ, আগ্রা, বাংলাদেশ, পেগু, দক্ষিণ-ভারত ও সিংহলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভ্রমণ করেছেন। আর সে সমস্ত অঞ্চলের মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের প্রতিচ্ছবি তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে লিপিবদ্ধ করেছেন।
জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে বহু ইউরোপীয় ভারতবর্ষে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উইলিয়াম হকিন্স ছিলেন উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৬০৮ খ্রি. ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের দূত হয়ে মুঘল রাজদরবারে উপস্থিত হলে জাহাঙ্গীর তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। এক সময়ে তিনি জাহাঙ্গীরের বন্ধুতে পরিণত হন। তিনি ১৬১১ খ্রি. পর্যন্ত ভারতবর্ষে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর ভ্রমণ বত্তান্তে তিনি জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে এক জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেন।
১৬১৫ খ্রি. রাজা প্রথম জেমসের চিঠি নিয়ে এডওয়ার্ড জাহাঙ্গীরের দরবারে এসেছিলেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ বিবরণীতে জাহাঙ্গীরের রাজদরবারের যেসব ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ করেছেন তাতে সেই সময়ের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। টমাস রো রাজা প্রথম জেমসের দূত হিসেবে জাহাঙ্গীরের দরবারে আগমন করেন। তিনি মুঘল রাজ দরবারের রেন। তিনিই ঐশ্বর্য দেখে অভিভূত হন। তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে মুঘল রাজদরবারের দলীয় ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার নির্ভরযোগ্য ও তথ্যবহুল বিবরণী পাওয়া যায়।
জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে ১৬২৩ খ্রি. ইতালীয় পর্যটক পিয়েত্রে দেল্লা ভালে- সুরাটে আগমন করেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ বিবরণীতে ধর্মীয় সহনশীলতার সঙ্গে গুজরাটে নিষ্ঠুর সতীদাহ প্রথার অবনয়নের কথা তুলে জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে আগত ধরেছেন। ডাচ্ পরিব্রাজক ফ্রান্সিসকো পেলসার্ট কর্তৃক রচিত 'জাহাঙ্গীরের ভারত' মুঘল যুগের ইতিহাস রচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করে তার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেন।
জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের অন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ পরিভ্রাজক হলেন ডিলেট। তিনি তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে নুরজাহানের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের বিবাহের কথা তিনি বর্ণনা করেছেন- যা জাহাঙ্গীর তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন নি। তাঁর রচনা ইম্পেরীয় ম্যাগনি মোঙ্গলিস থেকে মুঘল ভারতের বহু অজানা তথ্য গাওয়া যায়।
শাহজাহানের রাজত্বকালে যে কয়জন পরিব্র ভারতে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে ব্রুটন ও কার্টরাইট নামক দুজন ইউরোপীয় ব্যবসায়ীর নাম পাওয়া যায়। তাঁরা ১৬৩২ খ্রি. বঙ্গদেশ ও ও উড়িষ্যা ভ্রমণ করেছিলেন। al তাঁদের ভ্রমণ বৃত্তান্তে বঙ্গদেশ ও উড়িষ্যার তৎকালীন অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। ফরাসি পর্যটক ট্যাভার্নিয়ের ভ্রমণ বৃত্তান্তে মুঘল যুগের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি রয়েছে। তিনি ১৬৪০-১৬৬৭ খ্রি. পর্যন্ত ভারতবর্ষে ছিলেন। তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত মুঘল ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মানরিখের ভ্রমণ কাহিনী ২ খণ্ডে লেখা হয়। ১৬২৯-৪৩ খ্রীঃ পর্যন্ত মানরিখ ভারতের গ্রামাঞ্চল, নগর সর্বত্র ঘোরেন। ভারতীয় কৃষকদের ওপর সরকারি কর্মচারীদের জুলুম তাঁর চোখ এড়ায়নি।
মোগল আমলে ভারতে আগত ইউরোপীয় পর্যটকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফরাসি পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্ণিয়ে। ডাক্তারির ছাত্র বার্ণিয়ের ভ্রমণের নেশা ছিল। ভ্রমণের সূত্র ধরেই তিনি ভারতে এসে উপস্থিত হন। তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত 'ভয়েজেস' থেকে মোগল ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের বহু তথ্য পাওয়া যায়। সমসাময়িক অন্যান্য পর্যটকদের বিবরণীর সাথে তাঁর পার্থক্য হল অন্যরা ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন, কিন্তু তিনি ঘটনার পশ্চাদপট ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু বিশ্লেষণ সংযোজন করেছেন। ১৬৫৮ খ্রিঃ শাহজাহানের অসুস্থতার সুযোগে তাঁর পুত্রদের মধ্যে ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের সময় বার্ণিয়ে দিল্লীতে আসেন। তিনি সিংহাসনের উত্তরাধীকার দ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষ করে চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর বর্ণনা থেকে ঔরঙ্গজেবের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও কুটবুদ্ধির চিত্রটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সরকারি কাজে তিনি ভারতের বড়বড় শহরে গিয়ে প্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। শাহজাহান, ঔরঙ্গজেব, দারা, সুজা, মুরাদ, জাহানারা, রোশেনারা এমনকি মীরজুমলা ও শায়েস্তা খাঁর কথাও বার্ণিয়ে উল্লেখ করেছেন। ফরাসি মন্ত্রী কলবেয়ারকে মোগল শাসনতন্ত্রের কথা বিস্তারিতভাবে জানিয়েছেন। কীভাবে ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ সুবিধা আদায় করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন।
বার্নিয়ে তাঁর বিবরণীতে ইউরোপীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে ভারতের তুলনা করে বলেছেন, ভারতকে যথার্থ রাষ্ট্র আখ্যা দেওয়া যায় না। ইউরোপের রাষ্ট্র অনেক বেশি উন্নত, আধুনিক ও যুক্তিবাদী। সেখানে ভারত অনুন্নত, যুক্তিহীন ও অজ্ঞ। ভারতে উত্তরাধিকার আইন না থাকায় গৃহযুদ্ধ অনিবার্য। বানিয়ে মোগল সম্রাটদের স্বৈরাচারীর পাশাপাশি স্বেচ্ছাচারী বলেও উল্লেখ করেছেন। তাঁর চোখে ঔরঙ্গজেব ছিলেন ক্ষমতালোভী, কূটকৌশলী। বরং আকবর ও জাহাঙ্গীর ছিলেন সহিষষ্ণু। ঔরঙ্গজেব এত বেশি কর সংগ্রহ করেছিলো, যার জন্য হিন্দুস্তানে শিক্ষা, কলা ও বিজ্ঞানের উন্নতি : হয়নি। বার্ণিয়ে লিখেছেন, 'জায়গীরদারের শোষণ, লুণ্ঠনের আশঙ্কায় কৃষক জমির উন্নয়ণে উৎসাহ দেখাত :না। অনেক সময় অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হিন্দু রাজাদের নিকট আশ্রয় নিত।' দিল্লী ও আগ্রা শহরের যে বর্ণনা বানিয়ে দিয়েছেন তা এক কথায় অমূল্য। মোগল সম্রাট ও অভিজাতদের বিপুল সম্পদের কথাও বার্ণিয়ের বিবরণে পাওয়া যায়।
বার্ণিয়ের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলা যায়,তিনি মোগল যুগের যে বর্ণনা দিয়েছেন তার মধ্যে খুব বেশি ভুল ছিল না বলে অনেকে মনে করেন। কলবেয়ারকে লেখা চিঠিতে তিনি দিল্লীশ্বরের ধন-দৌলত,সৈন্যবাহিনী, দেশের আয়তন, কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। অত্যাধিক করের বোঝা এবং জায়গিরদারদের অত্যাচার কিংবা জমিদারের শোষণে কৃষক গ্রাম ছেড়ে চলে যেত তা অকন্যান্য সূত্র থেকে সমর্থিত হয়েছে। বার্ণিয়ের কৃতিত্বেরক মুগ্ধ হয়ে পরবর্তীকালের পর্যটক কাউন্ট অব মোদভ তাকে 'পর্যটকদের যুবরাজ' বলে অভিহিত করেছেন।
ট্যাভার্নিয়ে ও বার্নিয়ে ছাড়াও আওরঙ্গজেবের শাসনকালে যে গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় পরিব্রাজক ভারতবর্ষে আসেন তিনি হলেন ইতালীয় পরিব্রাজকমানুচি। মানুচি ১৬৫৩-১৭০৮ খ্রি. পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ভারতবর্ষে অবস্থান করেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত 'Stories do mogor' নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন।
তবে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে যে, কিছু পর্যটকদের বিবরণ ত্রুটিযুক্ত। কারণ তারা এদেশের ঐতিহ্য সংস্কৃতি তথা ভাষার সঙ্গে তেমন ভাবে অবগত ছিলেন না, অনেকেই ধর্মপ্রচারের জন্য এদেশে এসেছিলেন গোঁড়া ধার্মিক হিসেবে, অনেকে ব্যবসায়ী মনোভাব নিয়ে। কাজেই তাঁদের বক্তব্যগুলিকে সাবধানতার সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত।