সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কিভাবে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র গড়ে উঠেছিল

 সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কিভাবে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র গড়ে উঠেছিল 

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কিভাবে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র গড়ে উঠেছিল


ইউরোপের নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের প্রসঙ্গে উঠলেই সবার : আগে যার কথা মাথায় আসে তিনি হলেন ফ্রান্সের সম্রাট চতুর্দশ লুই। তিনি যথাযথভাবে বলেছিলেন আমিই রাষ্ট্র (I am the State.) ) মূলত মূলত এই উক্তিটি নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের সংজ্ঞা নির্দেশ করে। মূলত যে রাষ্ট্রে, রাজা বা রানী প্রকৃত সার্বভৌম শাসক। রাষ্ট্রের  প্রশাসনিক বিচার বিভাগীয় ও সামরিক সকল বিষয়ের ওপর তার একচেটিয়া অধিকার থাকে। রাজা থাকেন আইনের ঊর্ধ্বে। মানুষ সৃষ্ট আইন তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। একমাত্র প্রাকৃতিক ও দৈব আইনের ধারায় তিনি নিয়ন্ত্রিত, প্রবল প্রতাপশালী চার্জ এর বিরোধিতা করার ক্ষমতাও রাখেন, সেই রাষ্ট্রকে বা রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থাকে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র বলা হয়ে থাকে। সপ্তদশ অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেমন ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, ডাচ রিপাবলিক, ইংল্যান্ড প্রুশিয়া(আধুনিক জার্মানি) প্রভৃতি।


আমরা এই নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের বিশেষ কতগুলি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করি। যেমন- রাজা বা রানী ছিলেন প্রকৃত সার্বভৌম শাসক, তিনি আইনের ঊর্ধ্বে, আমলাতন্ত্র তাকে রাষ্ট্রীয় কাজে সহায়তা করতো, আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি ছিল সম্পূর্ণ রাজার ইচ্ছের উপর নির্ভরশীল, এখানে স্থায়ীণ বেতন ভুক্ত সেনাবাহিনী ছিল, যুদ্ধ ছিল এই রাজতন্ত্রের অপরিহার্য অঙ্গ, মার্কেন্টাইল অর্থনীতি অনুসরণ করে রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি সাধন ছিল অর্থনীতির প্রধান লক্ষ্য, এক্ষেত্রে রোমান আইন ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।


এখন দেখা যাক, এই সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কিভাবে বা কি কারণে এই নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র গড়ে উঠলো। মধ্যযুগীয় ইউরোপে রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রকৃতি ছিল মূলত সামন্ততান্ত্রিক। ধীরে ধীরে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটে এবং উত্থান ঘটে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের। তবে এই নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র গড়ে ওঠার পিছনে একাধিক কারণ ছিল-


নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের রাজারা তাদের শু ক্ষমতা ঈশ্বর প্রদত্ত বলে মনে করতেন। রাজা কেবলমাত্র ঈশ্বরের কাছেই দায়বদ্ধ থাকবে, অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে নয়। ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস শক্তিশালী রাজতন্ত্রের সপক্ষে তার 'দ্যা ল অব ফ্রি মোনার্কস' গ্রন্থে বেশকিছু বৈশিষ্ট্য সমূহের কথা বলেন- রাজা প্রত্যক্ষভাবে 'ঈশ্বরের কাছ থেকে ক্ষমতা লাভ করেন, জনগণের কাছে রাজার কোনো বৈধ বা আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই, আইন স্বয়ং রাজা কর্তৃক সৃষ্ট। এই কারণে বিধিসম্মত ভাবে কার্তত বা প্রস্তুত করার অধিকার বাজার আছে। আইন বা অনুশাসন কখনই রাজার উর্ধ্বে নয়, রাজা তার প্রজাদের উপর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী অর্থাৎ জনগণের ইহলৌকিক বা পারলৌকিক সকল জীবনের ক্ষেত্রেই রাজার অধিকার স্বীকৃত, প্রজারা রাজার

সর্বময় ক্ষমতা বা সকল আদেশ নির্দেশ মেনে নিতে রাধ্য থাকবে। 


জার্মানির ব্যাডেন প্রদেশের রাজা ফ্রেডারিখ বলেন, ['আমরা তাদের বাধ্য করবো তারা পছন্দ করুক বা না

কুক যুক্ত পাচর্যা পূর্ণ এবং সদর নাগরিক হিসেব 

গড়ে উঠার ক্ষেত্রে'। ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস শক্তিশালী টমাস রাজতন্ত্রের সপক্ষে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেন। সপ্তদশ শতকে ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশৃঙ্খলা, অনৈক্য স্টুয়ার্ট রাজা চালর্সের প্রাণদন্ড ইত্যাদি ঘটনায় শক্তিশালী ক্ষমতার অধিকারী রাজতন্ত্রই ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতির একমাত্র সমাধান বলে তিনি মনে করেন।




রাজতন্ত্রের উত্থানের পিছনে ক্রুসেড অন্যতম প্রধান কারণ। ক্রুসেডের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করেছিল। এছাড়া ক্রুসেড সামন্তরাজা এবং যাজক সম্প্রদায়ের মনোযোগ অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে সরিয়ে বৈদেশিক নীতির দিকে ধাবিত করে। রাজারা সামন্তবাদ এবং চার্চ এর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে শুরু করে। এ ছাড়াও মধ্যযুগে অত্যন্ত প্রভাবশালী সামন্ত প্রভুরা ক্রসেডের ফলে ক্ষমতা হারাতে শুরু করে। এদের মধ্যে অনেকেই বাধ্য হয়ে রাজার আনুগত্য মেনে নেয়। এভাবে ষোড়শ শতাব্দীর শেষার্ধে সামন্তবাদের পতন ত্বরান্বিত হলে অভিজাত শ্রেণীও  শক্তিশালী রাজতন্ত্রকে ব্যাপকভাবে সমর্থন করে। 



রাজতন্ত্রের উত্থানের পিছনে রাজনৈতিক কারণত

গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সামন্তযুগে দুর্বল রাজতন্ত্রের কারণে মানুষ নানা রকম বিশৃঙ্খলা এবং অন্যায় অরাজকতার ফল ভোগ করে। এ সময় সামন্ত প্রভুরা · নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী এবং সব বিষয়ে স্বেচ্ছাচারী রাজাকে চালিত করতো। দেশের অধিকাংশ মানুষ সেই সময় একটি শক্তিশালী এবং স্থায়ী রাজতন্ত্র আশা করেছিল যা তাদেরকে শান্তিও নিরাপ্তরা নিশ্চয়তা দেবে। মার্কেন্টাইলবাদ যেমন অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব এনেছিল, তেমনি শক্তিশালী রাজতন্ত্র সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা আনবে বলে বিশ্বাস করা শুরু হয়।



শক্তিশালী রাজার নেতৃত্বে সামন্তবাদকে উচ্ছেদ করে চার্চকে রাষ্ট্রের অধীনে নিয়ে এসে নতুন রাজনৈতিক পথের সূচনা হয়। এ ছাড়াও ইউরোপের দেশে দেশে যুদ্ধ, ফ্রান্সের ধর্মযুদ্ধ, জার্মানির ত্রিশ বছরব্যাপী যুদ্ধ, ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ সব কিছুই দুরূহ পরিবেশ সৃষ্টি করে। নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভবের ফলে বিকল্প হিসেবে দেশের ভিতরে এবং বাইরে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। অনেকে রাজার ক্ষমতাকে রাষ্ট্রের প্রধান বা পবিত্র সত্তা হিসেবে মান্য করে। যুদ্ধ ও শান্তির প্রতীক হিসেবে দেখার চেষ্টা করে।


রেনেসাঁস যগের রোমান আইনের পনরুজ্জীবন শক্তিশালী রাজতন্ত্রের উত্থানের ক্ষেত্রে একটি অন্য বড় কারণ। প্রাচীন রোমান আইন বিশেষত বাইজানটাইন আইন অনুযায়ী রাজা শুধু আইন প্রণয়নের ক্ষমতাই রাখেন না বরং সে আইন পরিবর্তন  এমনকি ভঙ্গ করতেও পারেন না। রাজার ইচ্ছাই আইন এই নীতি অনুসরণে তিনি কোনো ভুল করতে পারেন না। আধুনিক যুগের প্রারম্ভে বিশেষত রেনেসাঁসের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে রোমান আইনের ব্যাপক পঠনপাঠন শক্তিশালী রাজার উত্থানকে সমর্থন এবং জনপ্রিয় করতে থাকে।



 শক্তিশালী রাজতন্ত্রের উত্থানের ক্ষেত্রে জাতীয়াবাদ এবং স্বদেশ প্রেমের চেতনা একটি বড় ভূমিকা পালন করে। দেশপ্রেমিক জনতা শক্তিশালী রাজাকে তাদের

দেশের ঐক্য এবং সমৃদ্ধির জীবন্ত প্রতীক হিসেবে মনে করতো। রাজা দেশের স্বাধীনতা এবং শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতে থাকেন। এই সময় রাজা এবং সম্রাট কথাটি সমার্থক হয়ে উঠতে থাকে। রাষ্ট্রের সকল বিষয- যেমন আইন, ন্যায়, অন্যায়, খাজনা আদায়, ব্যবসা-বাণিজ্য, সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ, যুদ্ধ ঘাষণা, শান্তি ইত্যাদি সকল কিছু রাজার নিয়ন্ত্রনে থাকবে বলে বিবেচিত হতে থাকে।


ভৌগোলিক আবিষ্কার এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের

উদ্ভাবন শক্তিশালী রাজতন্ত্র গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার রাজার ক্ষমতাকে সংহত করে। এই যুদ্ধাস্ত্রের মাধ্যমে রাজারা সামন্তপ্রভুদের দুর্গেই শুধু আঘাত হানতে সক্ষম হননি তার সঙ্গে সামন্ত প্রভুদেরও তাদের পদানত রাখতে সক্ষম হয়ে ছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কারখানার মালিক এবং ব্যবসায়ীরা জানত তাদের জীবনের শান্তি, শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা বিধান শুধু দায়িত্বশীল সরকারের মাধ্যমেই সম্ভব। 


ধর্মসংস্কার আন্দোলন শক্তিশালী রাজতন্ত্রের ভাবানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সমগ্র ইউরোপীয় দেশসমূহ নিজস্ব চার্চ প্রতিষ্ঠা করে যা অখন্ড পবিত্র রোমান চার্চের ধারণাকে বাতিল করে দেয়। এমনকি

যেসব দেশ রোমান ক্যাথলিক ধর্মে বিশ্বাসী ছিল সেখানে ক্যাথলিক চার্চ ছিল দুর্বল। যেখানে প্রোটেস্টান্ট মতবাদ গড়ে ওঠে সেখানেই রাজতন্ত্র শক্তিশালী হয় । চার্চের বিশপ শক্তিশালী রাজা বা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতো চাকুরীর পদোন্নতি ও বেতন সরকারি নিয়মে প্রদান করা হতো। বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে প্রোটেস্টান্ট রাজা চার্চের সম্পত্তি এবং মঠের জমি বাজেয়াপ্ত করে তাদের ক্ষমতা - শক্তিশালী করে গড়ে তোলেন। নতুন বিকশিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিলামের মাধ্যমে চার্চের জমি কিনে নেয় । এই উত্থিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে যারা শান্তি, আইন-শৃঙ্খলা চেয়েছিল, তারা তারা রাজাদের রাজাদের সবর্তোভাবে সবর্তোভাবে সাহায্য করে।



 উপরিউক্ত কারণের প্রেক্ষাপটে ইউরোপের বুকে  একাধিক শক্তিশালী রাজবংশের উত্থান ঘটে। যেমন- • স্টুয়ার্ট, টিউডর, বুরবোঁ, হ্যাপসবার্গ ইত্যাদি। এই সব রাজবংশ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক ও জাগতিক উন্নতির ক্ষেত্রে জাতীয় সম্মান ও গৌরবকে সমুন্নত করতে চেষ্টা করে। এর পাশাপাশি জার্মানির হোহেনজোলার্ন এবং রাশিয়ার রোমানভ বংশ নিজ নিজ দেশের সম্মান, মর্যাদা এবং শক্তির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এইভাবে ইউরোপের মাটিতে শক্তিশালী রাজতন্ত্র সর্বোত্তম ব্যবস্থা হয়ে ওঠে।


About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟