ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের অবক্ষয় বা অব- উপনিবেশিকরণ বা উপনিবেশবাদের অবসান সম্পর্কে আলোচনা কর
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে ঠান্ডা লড়াই-এর সূচনার মতোই অত্যন্ত গুরুত্বপূ ছিল বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা বিশ্বজুড়ে ইউরোপীয় অর্থাৎ পশ্চিম সাম্রাজ্যবাদের দ্রুত অবক্ষয় ও সেই সূত্রধরে পরিণামে উপনিবেশবাদের অবসান 'Decolonization' বা অব-উপনিবেশীকরণ বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্বরাজনীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল । বিশ্বব্যাপী প্রসারিত ব্রিটিশ, ফরাসি, স্পেনীয়, ডাচ, ইতালীয় ও পোর্তুগিজ উপনিবেশসমূহ তথা অধীনস্থ দেশগুলিতে যেমন এশিয়ায় ভারত সিংহল, বার্মা, মালয়, ইন্দোচীন, ফিলিপিনস্, ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকায় গোল্ডকোস্ট নাইজেরিয়া, উগান্ডা, মরক্কো, কেনিয়া, আলজিরিয়া প্রভৃতি দেশে দেশে আলোছ সময়ে জাতীয়তাবাদের। হবসম এই প্রবণতাকে অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে ব্যাখা করেছেন । তাঁর ভাষায়, 'Decolonization and revolution dramatically transformed the political map of the globe'।
![]() |
18 ফেব্রুয়ারি 1818 সালে চিলির স্বাধীনতার ঘোষণা |
মূল লাতিন শব্দ 'colonia' (বিশাল ভূসম্পত্তি বা estate) কে ইংরেজি 'Colonialism' শব্দটি উদ্ভূত। উইনস্লো'-র ভাষায়, 'Occupation of virgin territory in whi conflict was incidental, or even unnecessary, and subordinate to desire of Europeans to find a new place to live'। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীর Mercantilism বা বাণিজ্যিক মূলধনবাদের মোড়কে যে ধ্রুপদী সাম্রাজ্যবাদ (Classic Imperialism)-এর সূচনা হয়েছিল তা প্রারম্ভিক পর্যায়ে ঔপনিবেশিকতার বিস্তার ঘটায় অবশ্য ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পরিস্থিতিতেই ব্যাপকভাবে উপনিবেশবাদের প্রসার ঘট এবং সেই সূত্র ধরে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে পুঁজিবাদী শিল্পোন্নত রাষ্ট্রশক্তিগুলি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার নগ্ন প্রতিযোগিতায় নামে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় মূলত উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় একাঙ্কি ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। ভি. কে. মালহোত্রার কথায়, 'Thus a stage was set for the process of decolonization'।
![]() |
প্রতিটি দেশের স্বাধীনতা অর্জনের বছরের মানচিত্র |
এই অব-উপনিবেশীকরণ প্রসঙ্গে একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরা যেতে ১৯১৯ সালে যেখানে ভূমণ্ডলের ৭৭.২ শতাংশ ছিল উপনিবেশ এবং জনসাধারণ । ৬৯.২ শতাংশ, ১৯৭০ সালে সেখানে পৃথিবীতে উপনিবেশ ছিল মাত্র ৪ শতাংশ । জনসংখ্যা ছিল বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ এবং ২ শতাংশ ৷
![]() |
প্রিন্স পেড্রো 7 সেপ্টেম্বর 1822 সালে নিজেকে একটি স্বাধীন ব্রাজিলের সম্রাট ঘোষণা করেন |
বলার অপেক্ষা রাখে না যে 'ডিকলোনাইজেসন' বা অব-উপনিবেশীকরণের প্রক্রি সমাপ্তি আধুনিক বিশ্বের তথা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে এক নতুন যুগ করেছিল। ব্যারাক যথার্থই মন্তব্য করেছেন, 'with the end of colonialisma phase of world history had begun'। ঔপনিবেশিকতার অবসানের প্রকৃত সূচনা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই। এই সময়ে এশিয়া ও আফ্রিকার উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তিআন্দোল বিশেষভাবে বেগবান হতে শুরু করে। একে একে সব উপনিবেশই পরবর্তী দু'দশরে মধ্যে ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে এসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি এই প্রবণতাকেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান ১৯৬০ সালের জানুয়ারি 'Wind of Change' বা 'পরিবর্তনের হাওয়া' বলে উল্লেখ করেছিলেন ৷
![]() |
1952 সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য |
অব-উপনিবেশীকরণ বা উপনিবেশবাদের চূড়ান্ত অবসান ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ঠিকই, কিন্তু এর সূত্রপাত হয়েছিল তারও আগে, মোটামুটিভাবে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই । অব উপনিবেশীকরন প্রক্রিয়ার পিছনে একাধিক কারণে সমন্বয় লক্ষ্য করা যায় ।
![]() |
1781 সালে ইয়র্কটাউনে লর্ড কর্নওয়ালিসের আত্মসমর্পণ |
সর্বোপরি, অব-উপনিবেশীকরণের পিছনে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভূমিকা ছিল প্রশ্নাতীত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মিত্রশক্তিজোট (Allied Powers) তাদের অধীনে থাকা উপনিবেশগুলির কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে যুদ্ধশেষে উপনিবেশের জনগণ স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসন লাভ করবে এবং এই কারণেই যুদ্ধাবসানের অব্যবহিত পরেই উপনিবেশবাসীরা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির কাছে দাবি জানিয়েছিল যুদ্ধকালীন প্রতিশ্রুতি রাখার অর্থাৎ অবিলম্বে গণতন্ত্র এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করতে হবে । অপর একটি বিষয় এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, যুদ্ধে মিত্রশক্তির জয় হলেও তাদের বিশেষত ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলিকে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হয়েছিল। এমতাবস্থায়, সবদিক থেকে বিধ্বস্ত পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে আর উপনিবেশগুলির বোঝা বহন করা সম্ভব ছিল না । পরিস্থিতি সাপেক্ষে তারা ক্রমে বাধ্য হয়েছিল উপনিবেশগুলিকে স্বশাসনের অধিকার দিতে ।
![]() |
"মাদাগাস্কার যুদ্ধ" সম্পর্কে ফরাসি পোস্টার |
উপনিবেশগুলির মানুষজনের নিত্যসঙ্গী ছিল দুঃখকষ্ট, যন্ত্রণা, শোষণ, দারিদ্র্য, অনাহার, অশিক্ষা, লাঞ্ছনা ও অবমাননা । এইসব দুর্দশা ও যন্ত্রণা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় ছিল স্বশাসন । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এবং যুদ্ধের পর এই শোষণ ও যন্ত্রণার পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল । এর প্রধান কারণ ছিল ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, কর্ম সংকোচন, নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাব, ত্রুটিপূর্ণ বণ্টন ব্যবস্থা, মূল্যবৃদ্ধি, মূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক ব্যর্থতা, কালোবাজারি, খাদ্যমজুতদারদের সীমাহীন লোভ ও মুনাফা ইত্যাদি । যুদ্ধশেষের প্রতিক্রিয়া হিসেবে সারা বিশ্বে আলাদাভাবে উপনিবেশসমূহে দারিদ্র্য- দুর্দশার পরিমাণ মাত্রা ছাড়িয়ে যায় । এই পরিস্থিতিতে অব-উপনিবেশীকরণের প্রয়োজন জোরালোভাবে অনুভূত হয় ।
যুদ্ধোত্তর দুনিয়ায় অন্যতম মহাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান এবং সাবেকি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির অবক্ষয় উপনিবেশবাদের অবসানে বিশেষ সহায়কহয়েছিল। প্রধানত তিনটি কারণে সুপার পাওয়ার আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকা পশ্চিমি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলিকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছিল তাদের অধীন উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতা প্রদান করতেঃ (ক) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায়নি ব্রিটেন, বা ও স্পেন-এর মতো পশ্চিমি শক্তিগুলি নতুন করে তাদের উপনিবেশগুলির সাহায্য শক্তিশালী হয়ে উঠুক। (খ) তার দাবি ছিল মিত্রশক্তিসমূহ তাদের যুদ্ধকালীন প্রতিশ্রুতি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান এবং বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা, যথাযথভা পালন করুক। আমেরিকা আশা করেছিল, এর ফলে যে মুক্ত দুনিয়া আত্মপ্রকাশ করার তা তার ব্যবসা-বাণিজ্যের সহায়ক হবে। (গ) অন্যদিকে, ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি অপসারণে যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে আমেরিকা তা পুরণ করার বাসনা পোষণ কার অনুরূপভাবে মার্কিন রাষ্ট্রশক্তি ভেবেছিল যে দ্বি-মেরু বিশ্বে ক্রমবর্ধমান সোভিয়ে বলয়ের বিপরীতে তার নিজের প্রভাব-বলয় সম্প্রসারিত হবে।
সাম্যবাদের দ্রুত প্রসার ও আলাদাভাবে সমাজতন্ত্রী শক্তি হিসেবে সোভিরে ইউনিয়নের জোরালো উপস্থিতি উপনিবেশবাদের ওপর চরম আঘাত হেনেছিল ৷ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রচণ্ড রকম উপনিবেশবিরোধী এবং বিশ্বের যে-কোনো প্রান্ত থেকে ঔপনিবেশিকতা মুছে ফেলতে সে সক্রিয় ছিল ৷ প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে কমিউনিস্টরা উপনিবেশগুলিতে বহুলাংশে জাতীয় আন্দোলনও প্রভাবিত করেছিল এবং সেগুলিকে কমিউনিস্ট আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে সচেষ্ঠ ছিল । এর ফলে বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্ট প্রভাববৃদ্ধির আশঙ্কায় এবং উপনিবেশগুলির সম্ভাব্য সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে পশ্চিমি শক্তিগুলিও উপনিবেশগুলিয়ে স্বাধীনতাদানের প্রস্তুতি নিতে থাকল এবং দেশে দেশে অ-কমিউনিস্ট জনগণ ও রাজনৈরি দলগুলির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করল। মনে রাখা প্রয়োজন! আধুনিক সাম্যবাদের জনক মার্কস ও তাঁর অনুগামীরা তাঁদের রচনায় উপনিবেশবানে স্বরূপ ও জনগণের ওপর চলা ঔপনিবেশিক শোষণ ও অপশাসন নিয়ে বিশদ আলোর করে গেছেন। আসলে, ঔপনিবেশিকতার দিন ফুরিয়ে এসেছিল।
প্রধানত ভারতের নেতৃত্বে সংগঠিত নির্জোট আন্দোলন (NAM) দুটি প্রতিবর্ব শক্তিজোট থেকে সমদূরত্বে থাকা তৃতীয় বিশ্ব অর্থাৎ আফ্রো-এশীয় দুনিয়া থেরে উপনিবেশবাদের অবসানে বিশেষ সাহায্য করেছিল। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেবে উপনিবেশবাদ-বিরোধী সংগ্রামে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন ও এই স্বাধীনতার লড়াই তাদের পাশে সতত থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।
রাষ্ট্রসংঘের গঠন ও তার কর্মসূচি উপনিবেশগুলির বিলুপ্তিতে বিশেষ কাতা হয়েছিল। রাষ্ট্রসংঘের মহাসনদের (UN Charter) নানা অনুচ্ছেদে উপনিবেশগুলির স্বায়ত্তশাসন প্রদানের কথা বলা হয়েছে এবং রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাবিত নতুন বিশ্ব ছিল এ এক বিশ্ব যেখানে প্রতিটি জাতি ও রাষ্ট্র সমান মর্যাদা ও অধিকার অর্জন করবে। এর প্রয়োজনেই উপনিবেশবাদের অবসান জরুরি ছিল। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এশিয়া ও আফ্রিকার একের পর এক উপনিবেশ স্বাধীনতা অর্জন করে এবং দীর্ঘদিনের সাম্রাজ্যিক শাসনের অবসানের পর সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে যোগদান করে। পূর্বতন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিও রাষ্ট্রসংঘের ডাকে সাড়া দিয়ে ধীরে ধীরে উপনিবেশগুলিকে তাদের শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি দিয়েছিল। অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে জাগ্রত জনমতের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে ঔপনিবেশিক শক্তিসমূহ উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতা প্রদান করতে একরকম বাধ্য হয়েছিল। এসবের পরিণতিতে আত্মপ্রকাশ করেছিল একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র।
সর্বোপরি, বিশ্ব শান্তি রক্ষার জন্য গড়ে ওঠা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জও উপনিবেশ গুলির স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন এর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল । বিশিষ্ট ওলন্দাজ পণ্ডিত এইচ. এল. ওয়েসলিং (H. L. Wesseling) একদা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যসমূহের অব-উপনিবেশীকরণ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, 'Decolonisation has finished. It definitely belongs to the past. Yet somehow it has refused to become history.'