তুমি কি মনে করো জাপানের অর্থনীতির সংকট টোকু গাওয়া শোগুনদের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল
এশিয়া মহাদেশের পূর্ব পান্তে অবস্থিত সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের মিনামাটা জেরিটোমার হাত ধরে যে শোগুন শাসন শুরু হয়েছিল তা ১৮৬৭ সালে মেসিনোবুর পদত্যাগের মাধ্যমে তার অবসান ঘটে ৷ শোগুন নিয়ন্ত্রিত এই সামন্ত যুগ ১১৯২ থেকে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল ৷ দীর্ঘ 675 বছর ধরে শোগুন শাসকেরা যে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিল এবং যে সামাজিক কাঠামো গড়ে তুলেছিল তা কেন ভেঙে পড়ল এই প্রশ্ন নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে বহু বিতর্ক অবতীর্ণ হয়েছে ৷
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
শোগুন শাসনের পতনের কারণ বিশ্লেষণে G.C.Aller এবং Sir George Sansom অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও দুরবস্থা শোগুন শাসনের অবসানের প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করেছেন ৷ এলার অর্থনৈতিক সংকটকে প্রধান কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন ৷ ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে বিদেশে শক্তিবর্গের জাপানের বন্দরে প্রবেশ লাভ এবং ফলে জাপানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন শোগুন শাসন পতনের প্রধান বা মুখ্য কারণ এ কথা বলা ঠিক নয় ৷ তার মতে এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন এবং ক্রমাগত বৈদেশিক চাপে সৃষ্ট একটি অপ্রধান বা গৌণ কারণ মাত্র ৷ মেইজি যুগে অন্যতম প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ Prince Matsukate উক্তি করে বলেন Aller অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা কে মুখ্য কারণ হিসেবে গণ্য করেছেন ৷
প্রিন্স মাৎসুকাটা ও অ্যালেন উভয় মনে করেন 1867 সালের পূর্বে বহুৎ বৎসর জাপানে এক অর্থনৈতিক সংকট বিদ্যমান ছিল ৷ এই সংকট প্রস্তুত বিক্ষোভ ও আন্দোলন শাসনের তিনজন শোগুনের শাসনকালে জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থা মোটের উপর সচ্ছল ছিল ৷ কিন্তু সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এই স্বচ্ছলতার অভাব প্রথম পরিলক্ষিত হয় ৷ বিশেষত পঞ্চম শোগুন সুনাযোসির শাসনকালে প্রশাসনিক দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয় ৷ অনিয়ন্ত্রিত প্রশাসনিক ব্যয় তথা অগ্নিক্লান্ত ও ভূমিকম্প জনিত ক্ষয়ক্ষতির মেরামত বাবদ প্রচুর অর্থ ব্যয় রাজস্বের ঘাটতি সৃষ্টি করে ৷ এই সময় মুদ্রার মূল্য হ্রাসের ও প্রয়োজন হয় ।
অষ্টাদশ শতকে সাময়িকভাবে অর্থনৈতিক উন্নতি দেখা দেয় ৷ এই সময় চাল ও খনিজ সম্পদ থেকে কিছু রাজস্ব উপর উপস্থিত হয় এ৷ ই ব্যতীত বন্দর ও শহরাঞ্চলে যেসব বণিক ব্যবসায় লিপ্ত ছিলেন তাদের থেকেও কিছু রাজত্ব আদায় হয় ৷ ফলে কিছু পরিমাণে অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব হয় ৷ তখন বর্হিবাণিজ্য না থাকায় শোগুন সরকার আমদানি বা রপ্তানি কর থেকে বঞ্চিত ছিল ৷
অষ্টাদশ শতকের এই সামরিক অর্থনৈতিক সচ্ছলতার পর দেখা দেয় উনবিংশ শতকের দীর্ঘস্থায়ী ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট ৷ বাজেট আয় ব্যয়ের পার্থক্য প্রকট হয় ৷ ১৮০৪ থেকে ১১ সালের মধ্যে শোগুন সরকারের মোট আয় ছিল বছরে ১ মিলিয়ন রায়ো ৷ ১৮৭০ সালের পরবর্তীকালে যুদ্ধজাহাজ ক্রয়, জাহাজ নির্মাণের কারখানা স্থাপন, দুর্গ নির্মাণ এবং জাপানের উপকূল অঞ্চল রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি বাবদ সরকারের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয় ৷ বিশেষত ১৮৩০ থেকে ৪৩ টেম্পোযুগে ব্যয় ১৫ লক্ষ থেকে ২৫ লক্ষ বৃদ্ধি পায় ৷ এর উপর ছিল রাজস্ব বিভাগের দুর্নীতি পরায়ণ কর্মচারীরা ৷ কৃষকরা করভারে জর্জরিত হয়ে বিদ্রোহ শুরু করে ৷ ১৬০৩ থেকে ১৮৬৭ সালের মধ্যে ১১৫৩ বার কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয় ৷ ১৮৩৩ থেকে ৩৭ সালের বছর গুলি ছিল অজন্মার বছর ৷ বহু কৃষক পরিবার শহরে চলে আসে । এর মধ্যে 1819 থেকে 37 সালের মধ্যে ১৯ বার জাপানি ইয়েনেয মূল্য হাঁস পায় ৷ যা অর্থনৈতিক সংকটের ইঙ্গিত বহন করে ৷ এর ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি পায় মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবন যাপন দুর্বিসহ করে তোলে ৷
১৮৫৪ সালের পর বহিরবাণিজ্য শুরু হওয়ার ফলে চাল,চা এবং কাঁচা রেশম প্রচুর পরিমাণে বিদেশে রপ্তানি হতে থাকে ৷ ফলে দেশের মধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় এসব জিনিসের দাম দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায় । কাচা রেশমের মূল্য বৃদ্ধি পায় তিনগুণ এবং সাধারণ মানুষের প্রধান খাদ্য চালের মধ্যে পায় ১২ গুণ ৷ অপরদিকে বিদেশ থেকে সস্তা দরে কার্পাস বস্ত্র, সুতা ইত্যাদি আমদানি হওয়ায় জাপানের উৎপন্ন ঐ জাতীয় দ্রব্যের বিক্রয় মূল্য হ্রাস পায় ৷ পরিণামে যে সমস্ত জাপানি পরিবার ওই জাতীয় দ্রব্য বিক্রয় করে জীবিকা অর্জন করত তারা বিপন্ন হয়ে পড়ে ৷
ডাইমিয়া ও সামুরাই শ্রেণি ও জমিদারদের আয় কমে ৷ সানকিন কোটাযই বিধানের ফলে ডাইমিয় ব্যয় অধিকতর বৃদ্ধি পায় ডাইমিয়োরা বণিকদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয় ৷ ১৮৪৯ থেকে ৫৩ সালের মধ্যে ওয়ারির ডাইমিয়দের চালের হিসাব এর মোট দাঁড়িয়ে ছিল 18 মিলিয়ন কুকু ৷ সব সময় ডাইমিয়দের আর্থিক সচলতার অধিকতর শোচনীয় ছিল ৷ ১৮০৭ সালে তাদের ঋণের পরিমাণ ছিল ১.৩ মিলিয়ন রায়ে ৷ ১৮৩০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ মিলিয়ন রায়ে ৷ সামুরাইদের অবস্থা ছিল আরো খারাপ ৷ তারাও শ্রেণী সামুরাই বংশের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হয়, পোষ্য সন্তান গ্রহণ এবং বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ফলে একদিকে যেমন বণিক শ্রেণীর সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করে অন্যদিকে তেমনি সামুরাই মৈত্রী শাসন পতনের পথ সুগম করে ৷
টেম্পুোযুগে দেশব্যাপী এক ঘোরতর সংকটময় পরিস্থিতির উদ্ভব হয় ৷ ১৮২৮ থেকে ৩২ সালে অজন্মা ১৮৩৩ সালে উত্তর জাপানের দুর্ভিক্ষ এবং ১৮৩৬ সালে দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ জাতীয় জীবন বিপর্যস্ত করে তোলে ৷ মোটকথা উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে শোগুন শাস্তিত জাপানের প্রশাসন একেবারে ভেঙে পড়ায় এক ভয়াবহ সংকটের উদ্ভব হয় ৷ যে সংকটে রূপ ঝড়ের সম্মুখে শোগুনের সিংহাসনে উচ্ছিষ্ট পাতার মতো উড়ে যাওয়ার পর্যায়ে পৌঁছায় ৷ ডাইমিও, সামুরাই,কৃষক প্রভৃতি সকল শ্রেণীর সহকারে তখন বিক্ষুব্ধ স্থাপন প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি ও অমিতা ব্যয় ,ঘাটতি, বাজেট ,রপ্তানি অপেক্ষা আমদানি বৃদ্ধি ,মূল্য হাঁস মুদ্রাস্ফীতি, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধি, অজন্মা আর দুর্ভিক্ষ, মহামারী প্রভৃতি সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া শগুন যুগে অন্তিম কালে পৌঁছে দেয় ৷ তখন সকল শ্রেণীর মানুষই প্রশাসনিক ব্যবস্থা তথা সামাজিক অর্থনৈতিক উদগ্রীব ৷
শোগুন শাসনের রুদ্ধ দারের পশ্চাতে দাঁড়িয়ে সর্বশেষ মানুষ দরজা ভঙ্গ করে বাহিরে এসে এক নতুন পরিবেশের আশায় আবির হয়ে ওঠে ৷ ১৮৫৩ থেকে ৫৪ সালের সেই রুদ্ধদার মুক্ত করে কমোডর পেরি ৷ বহির্জগতের সামনেও উন্মুক্ত হওয়ায় রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে জাপানে তীব্র শোগুন বিরোধী আন্দোলন দেখা দেয় ৷ চারটি গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী সাতসুমা,চোস, হিডেন এবং তোসো রাজতন্ত্রের পক্ষ অবলম্বন করে শোগুন তন্ত্রের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে এবং শোগুন তন্ত্রের পতন সুনিশ্চিত করে ৷
