প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় দেশীয় সাহিত্যের গুরুত্ব লেখো। বা, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় দেশীয় সাহিত্যিক উপাদানের ভূমিকা আলোচনা করো।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদানকে আমরা দুটি ভাগে ভাগ করি। একটি সাহিত্যিক উপাদান, অপরটি প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সাহিত্যিক উপাদানের গুরুত্ব অপরিসীম। অন্যান্য দেশের তুলনায় প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার কাজ বেশ কঠিন। ড. ফ্লিট বলেছেন, প্রাচীন হিন্দুরা ইতিহাস লিখতে জানত না এবং তাদের ইতিহাসবোধও ছিল না। উদাহরণ হিসেবে প্রাচীন গ্রিস ও ইটালির উল্লেখ করা যায়। প্রাচীন গ্রিসের জন্য যেমন হেরোডোটাস, থুসিডিসিস ছিলেন তেমনই ইটালির জন্য ছিলেন লিভি এবং ট্যাকিটাস। কিন্তু প্রাচীন ভারতের জন্য তেমন কেউ ছিলেন না। প্রাচীনকালে লেখা কোনো ঐতিহাসিক গ্রন্থ পাওয়া যায়নি, ভারতে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটিকে ইতিহাসের মর্যাদা দেওয়া যায়, সেটি খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে লেখা কলহনেব 'রাজতরঙ্গিণী' অথচ ভারতের ইতিহাসের সূচনা সুদুর অতীতে।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার জন্য দেশীয় সাহিত্য হিসেবে ইতিহাস গ্রন্থের একান্ত অভাবের কারণ হিসেবে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভিন্ন মতপার্থক্য রয়েছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেছেন প্রাচীন ভারতে ইতিহাস গ্রন্থ লেখা হলেও কালের নিয়মে সেই প্রশ্নগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে এমন ধারণা যথার্থ সত্য বলে মনে হয় না। আবার কেউ কেউ বলেছেন প্রাচীন ভারতীয়রা ইহলৌকিক বিষয়ে ইতিহাস রচনায় তেমন আগ্রহ দেখায়নি।
আরবীয় পণ্ডিত আলবিরুণীর মতে, হিন্দুরা বিভিন্ন ঘটনার ঐতিহাসিক পরস্পরার দিকে মন দেয়নি। রাজাদের কালক্রম অনুসারে পরম্পরার বর্ণনায় তারা অত্যন্ত অন্যমনস্ক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা ইতিহাসের পরিবর্তে কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছে। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, সে সময়ে ইতিহাসচেতনা বা ইতিহাসের উপাদান কোনোটারই অভাব ছিল না। অভাব ছিল বিভিন্ন তথ্যের সাহায্যে প্রকৃত সাহিত্য গুণসম্পন্ন ইতিহাস রচনার উৎসাহের বা ইচ্ছার।
কারণ যাইহোক প্রাচীন ভারতের জন্য প্রাচীনকালে লিখিত মৌলিক ইতিহাস গ্রন্থের অভাব একটি ঐতিহাসিক তথ্য, এই অভাব ইতিহাস রচনার কাজকে কঠিন ও অনেকাংশে দুঃসাধ্য করেছে, কিন্তু অসম্ভব করেননি। কেননা ঐতিহাসিকরা অন্যান্য উপাদান থেকে ইতিহাসের তথ্য আবিষ্কারের, সংগ্রহের এবং প্রতিষ্ঠার নিরলস চেষ্টায় ব্যাপিত আছেন।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে দেশীয় সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার পরোক্ষ উপাদান হল প্রাচীনতম ভারতীয় সাহিত্য বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ও উপনিষদ প্রভৃতি। ভারতীয় সাহিত্যের আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথমেই বেদ এবং বৈদিক সাহিত্যের উল্লেখ করতে হয়। এ থেকে বৈদিক আর্যদের রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি এবং ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য জানা যায়। রামায়ণের বিষয়বস্তু রাম-রাবণের যুদ্ধ ঐতিহাসিক দিক থেকে আর্যদের সঙ্গে অনার্যদের সংঘর্ষের কাহিনি, যার ফলে আর্য সভ্যতা দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত বিস্তারলাভ করেছিল। মহাভারতের যুগে সমগ্র ভারতে আর্যসভ্যতার বিস্তৃতি ঘটে এবং সম্রাট যুধিষ্ঠিরের অধীনে সমগ্র ভারত রাজনৈতিক দিক থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর।
মহাকাব্য দুটির মধ্যে মহাকবি ব্যাসদেব রচিত মহাভারতকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। মহাভারতের শান্তিপর্বে ঐতিহাসিকরা রাষ্ট্রনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ধর্ম উপদেশ শুনিয়েছিলেন। তাছাড়াও এই দুটি মহাকাব্য থেকে সমসাময়িক সমাজ, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। তাই ইতিহাসের উপাদানরূপে এই দুটি মহাকাব্যের ঐতিহাসিক মূল্যকে কোনো অংশে অস্বীকার করবার উপায় নেই।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর পূর্বেকার ইতিহাস রচনার প্রধান উপাদান হিসাবে পুরাণের সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে মৎস্যপুরাণ, বায়ুপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, ভবিষ্যৎ পুরাণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রাজারাজড়াদের বংশতালিকা যেমন মহাকাব্যে রয়েছে তেমনই পুরাণগুলিতেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে। ইতিহাসের উপাদান হিসেবে বৌদ্ধ সাহিত্যের মধ্যে সর্বাপ্রেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল সিংহল অর্থাৎ, বর্তমান শ্রীলঙ্কায় প্রাপ্ত 'দ্বিপবংশ' ও 'মহাবংশ' এবং ভারতের বৌদ্ধধর্মের অমূল্যসম্পদ 'জাতক' খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 'দ্বিপবংশ' ও 'মহাবংশ' মৌর্যসম্রাট অশোকের জীবনী বর্ণনা করেছে। বৌদ্ধগ্রন্থসমূহে গৌতমবুদ্ধের পূর্ব জন্মচক্রবিষয়ক লোককাহিনি বর্ণিত হয়েছে। জৈনগ্রন্থ থেকেও খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর রাজনৈতিক অবস্থা এবং ষোড়শ মহাজনপদ সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে একাধিক জীবনীগ্রন্থ ও আঞ্চলিক গ্রন্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভদ্রবাহু রচিত 'জৈন কল্পসূত্র' থেকে সাধারণভাবে জৈন তীর্থঙ্করদের বিশেষ করে মহাবীরের জীবনী সম্পর্কে অনেক কথা জানা যায়। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সম্পর্কে জানার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল হেমচন্দ্রের লেখা 'পরিশিষ্ট পার্বণ'। এছাড়া মেরুতুঙ্গ সম্পাদিত 'লোকপ্রবন্ধ চিন্তামণি' এবং রাজশেখর সম্পাদিত 'প্রবন্ধকোষ' বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও পাণিনিব 'অষ্টাধ্যায়ী' ও পতঞ্জলির 'মহাভাষ্য'। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মহাকবি কালিদাসের লেখা 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম্', 'মহাবংশ', 'মালবিকা-অগ্নিমিত্রম্' প্রভৃতি নাটক ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, গদ্যে লেখা বাণভট্টের হর্ষচরিত, হর্ষবর্ধনের জীবনী সংকলিত একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।
এছাড়াও স্থানীয় ইতিবৃত্ত নেপাল, গুজরাট, সিন্ধু এবং কাশ্মীরের ইতিবৃত্ত ইতিহাস রচনায় বিশেষভাবে সাহায্য করেছে। এদের মধ্যে পদ্যে লেখা কলহনের রাজতরঙ্গিনীকে ভারতীয় সাহিত্যে প্রথম ইতিহাসের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কাশ্মীরের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে এই গ্রন্থটির ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না।