শেরশাহের শাসন সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা কর অথবা,শেরশাহের প্রশাসনিক কার্যকলাপ আলোচনা কর বা,শের শাহের শাসননীতি বর্ণনা করো।
ইতিহাসে আফগান বীর ফরিদ খান বা শেরশাহ এক বিরলতম ব্যক্তিত্ব ৷ তিনি মধ্যযুগে ভারতবর্ষের রাজনীতির মধ্যাকাশের সবথেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে নিজেকে বিদ্দমান করে তুলেছে । তার মাত্র পাঁচ বছরের স্বল্পকালীন শাসনে একাধিক সংস্কার এবং অভিনব উদ্ভাবনের সমন্বয়ে যে শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি নির্মাণ করেছিল তা তাকে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব দিয়েছে । কে.কে.কানুগো শেরশাহ নামক গ্রন্থে তাকে সুদক্ষ সেনা নায়ক ও সুদক্ষ প্রশাসক হিসেবে অভিনন্দন করেছেন ৷
শাসন ব্যবস্থাকে গতিশীল ও জনকল্যাণকর করে তুলতে ব্যাপক প্রশাসনিক সংস্কার সাধন করেন ৷ এই উদ্দেশ্য তিনি সমগ্র সাম্রাজ্যকে ৪৭ টি সরকার এবং প্রত্যেক সরকারকে আবার কয়েকটি পরগণায় বিভক্ত করেন ৷ সরকার পরিচালনার জন্য মুনসিফ-ই-মুনসিফান, সিকদার-ই-সিকদারয়ান নিযুক্ত করেন ৷ অপরদিকে পরগনা পরিচালনার জন্য আমির,সিকদার, খাজানজি,মুনসিফ প্রকৃতি কর্মচারী নিয়োগ করেন ৷ শেরশাহের আমলে বহু অংশের স্বশাসিত গ্রাম নির্মিত হয় এবং গ্রাম শাসনের জন্য খুৎ, মুকাদ্দাম,চৌধুরী, পাতিয়াল নামক বহু কর্মচারী নিয়োগ করেন ৷ শেরশাহ প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য দু'বছর অন্তর অন্তর সরকার ও পরগনার প্রধান প্রধান কর্মচারীদের বদলি করেন ৷ রাস্তায় হেঁটেছিলেন যা আধুনিক রাষ্ট্র তত্ত্বের এক অনিবার্য শর্ত ৷
কৃষি ও ভূমি রাজস্বের ক্ষেত্রে শেরশাহ অত্যন্ত উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিলেন ৷ তিনি জমি জরিপের বন্দোবস্ত করেন ৷ জমিগুলোকে উৎপাদক অনুযায়ী উৎকৃষ্ট,মাঝারি ও নিকৃষ্ট এই তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেন ৷ শেরশাহ জমিগুলোকে উৎপাদনের গড় অনুপাতে ⅓ অংশ রাজস্ব হিসেবে ধার্য করেন ৷
শাসনব্যবস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল কাবুলিয়াত ও পাট্টা ৷ এই অবস্থা দুটি হলো এক অঙ্গীকার পত্র যা কৃষক প্রদান করতেন ৷ সম্রাটের কি প্রাপ্য, তা স্বীকার করে চাষীকে দিতে হতো কবুলিয়াত । আর ওপর দিকে জমিতে চাষের অধিকার স্বীকার করে চাষীকে সম্রাট দিতেন পাট্টা ৷ এর ফলে ভূমির ওপর কৃষকের অধিকার আইনগত স্বীকৃতি লাভ করে এবং কৃষক অনেক বেশি নিশ্চয়তা লাভ করে ৷
শেরশাহ মুদ্রা ব্যবস্থার ও সংস্কার সাধন করেন ৷ তিনি রূপি নামক মুদ্রা ও দাম নামক তামার মুদ্রার প্রবর্তন করেন ৷ এ ছাড়াও তিনি স্বর্ণমুদ্রা ও প্রচলনের জন্য একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন ৷ দেশের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য তিনি সড়ক পরিবহনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছিলেন ৷ তবে বাংলাদেশের সোনারগাঁও থেকে সিন্ধু পর্যন্ত সড়ক-ই-আজম বা গ্র্যান্ডট্রাঙ্ক রোড শেরশাহকে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ করেছে ৷ শেরশাহ বৃহৎ পথ প্রান্তে সরাইখানা নির্মাণ করেন এই সরাইখানা কে কেন্দ্র করে বাণিজ্য ও গঞ্জ গড়ে ওঠে ৷ শেরশাহ বিপুল সামরিক বাহিনী গড়ে তুলেছিল ৷
শেরশাহ ন্যায় ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন ৷ তিনি বিচার ব্যবস্থার সমতা বিশ্বাস করতেন ৷ স্বয়ং সুলতান আপিল ব্যবস্থার নিষ্পত্তি করতেন ৷ বিচারের ক্ষেত্রে সন্তানের পরেই ছিল কাজির স্থান ৷ ঘোড়ার পিঠে ডাক ব্যবস্থা প্রচলন শেরশাহের অন্যতম উদ্ভাবনী কল্পনা, তিনি প্রত্যেকটি সরাইখানা গুলিকে গকচৌকি হিসাবে ব্যবহার করতেন ৷ শের শাহ গুপ্তচর ব্যবস্থাকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে তুলেছিল ৷ শেরশাহের শাসন ধর্মনিরপেক্ষতার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৷
শেরশাহ সংস্কারক নাকি আবিষ্কারক তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে ৷ আসলে শেরশাহ তার মাত্র ৫ বছরের স্বল্পকালীন শাসনের যে বিপুল কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল তার মধ্যে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সরকার, পরগনা বিভাজন , বিচারব্যবস্থাকে সমতার উপর প্রতিষ্ঠিত, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরণ, সামরিক বাহিনীর এগুলি ছিল আসলে পূর্ববর্তী শাসকদের সুব্যবস্থার সংস্করণ ৷ কিন্তু ঘোড়ার পিঠে ডাক ব্যবস্থা ও কাবুলিয়ত,পাট্টা ব্যবস্থা প্রবর্তন ছিল তার একান্ত উদাহরণ নৈতিক প্রতিভার পরিচয় ৷
তাই আলোচনা শেষে বলা যায় শেরশাহের মধ্যে ঘটেছিল সংস্কার পাশাপাশি উদ্ভাবনী আদর্শ সমন্বয়ে, তাই সংস্কার কর্মসূচি মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মৌলিকতাবাদ লক্ষ্য করা যায়, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন শেরশাহের চরিত্রে দৈত্ব্য ব্যবস্থার লক্ষণ ফুটে ওঠে ৷ শেরশাহ যদি আর কিছুকাল জীবিত থাকতো তাহলে হয়ত ভারতের ইতিহাসে মুঘলদের আবির্ভাব হয়তো ঘটতো না ৷"
সম্ভাব্য প্রশ্নঃ -
🔹শেরশাহের সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা কর
🔹শেরশাহের কৃতিত্ব আলোচনা কর
🔹শেরশাহের শাসন সংস্কার সম্পর্কে আলোচনা কর
🔹শেরশাহের শাসন ব্যবস্থা
🔹শেরশাহের রাজত্বকাল এর গুরুত্ব কী ছিল
🔹শেরশাহের শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
🔹শেরশাহের শাসন সংস্কারpdf
🔹শেরশাহের রাজস্ব ব্যবস্থা আলোচনা করো
🔹শেরশাহের শাসন ব্যবস্থায় কি কি মানবিক চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়
🔹শেরশাহের রাজত্বকাল এর গুরুত্ব কী ছিল