মহম্মদ বিন তুঘলক কোনদিনই তার রাজধানী দিল্লি থেকে দৌলতাবাদ স্থানান্তরিত করেননি, বরং দৌলতাবাদ একটি নতুন রাজধানীর স্থাপন করেন ?
তুঘলক বংশীয় সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তর ছিল তার দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য ঘটনা । জিয়াউদ্দিন বারানী, ইবনে বতুতা এবং ইসামি এই তিনজন সমসাময়িক ঐতিহাসিকের রচনায় সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের দিল্লি থেকে দৌলতাবাদের রাজধানী স্থানান্তরের গভীর বিবরণ দিয়েছেন । নিজামীর মতে,"মহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লী ত্যাগ করার পরিবর্তে দৌলতাবাদকে তার দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্যে ৷ "
আপনি চাইলে এগুলো পড়তে পারেন
দৌলতাবাদের রাজধানী স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে বারনে লিখেছেন যে সুলতান মোহাম্মদ বিন তুঘলক ভারতের ভৌগোলিক পরিস্থিতি দিক দিয়ে বিচার করে দিল্লি তুলনায় অধিকতর একটি কেন্দ্রীয় অঞ্চলে রাজধানীর স্থাপনের কথা চিন্তা করেছিলেন ৷" সৌভাগ্যবশত দৌলতাবাদ দেশের কেন্দ্রস্থলেই অবস্থিত ছিল । দিল্লি, গুজরাট, লক্ষ্ণৌ, সাতগাঁও, সোনারগাঁও, তেলেঙ্গানা, দারসমুদ্র এবং কাম্পিল এই সমস্ত জায়গায় ছিল দৌলতাবাদের সম দূরত্বে । সুলতান এই কেন্দ্রীয় অবস্থান থেকে সমগ্র সাম্রাজ্যের উপর তার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার জন্য দেবগিরিকে বেছে নেন ।
বারানীর বর্ণনা অনুসারে, সুলতান ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই দোয়াবা এলাকায় কর বৃদ্ধি করেন এবং তারপর রাজধানী দিল্লির নিকটবর্তী দেবগিরিতে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করেন । যদিও ইবনে বতুতার লেখায় সুলতানের কোনো প্রশাসনিক উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়নি, তবে তার বিবরণে মোহাম্মদ বিন তুঘলকের প্রতি জনগণের বিরূপ মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় । সমসাময়িক ঐতিহাসিক ইসামির বিবরণী থেকে জানা যায় যে দিল্লির অধিবাসীদের সুলতান শত্রু বলে মনে করতেন তাই তাদের জব্দ করার জন্য সুলতান দিল্লির ত্যাগ করে প্রজা দের দৌলতাবাদ যাবার নির্দেশ দেন ।
যাইহোক, বর্তমান ইতিহাসবিদরা সমসাময়িক লেখকদের রচনা অতিরঞ্জিত বলে মনে করতেন । বিশেষ করে, তারা বিশ্বাস করতেন যে দিল্লিতে বসবাসকারী প্রত্যেকেই কখনও শহর ছেড়ে দৌলতাবাদে চলে যাননি । ডঃ ইয়াহিয়া সির হিন্দের মন্তব্য প্রসঙ্গে ডঃ নিজামীর দাবি করেন যে, সুলতান দুই বছর আগে রাজধানী স্থানান্তরের পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন ।" সিড়ি হিন্দি লিখেছেন যে ১৩২৬ থেকে ২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দিল্লি ও দৌলতাবাদের মধ্যে রাস্তার প্রশস্ত অসংখ্য বৃক্ষরোপণ সরাইখানা বিশ্রাম এর জন্য রাস্তার দু'পাশে গৃহ ইত্যাদি নির্মাণের কাজ সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক সম্পন্ন করেন । ডক্টর হোসেন তৎকালীন লেখকদের মন্তব্য বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেন যে সাধারণ মানুষ বা হিন্দুদের নতুন রাজধানীতে যাওয়ার কোনো চাপ দেন নি । অর্থাৎ সুলতানের এই রাজধানীর স্থানান্তরের সিদ্ধান্তের ফলে সাধারণ মানুষের কোনো রুপ অসুবিধা হয়নি ।
সুলতানের রাজধানী স্থানান্তরের এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে রাজকোষ অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং দিল্লি তার পূর্ব গৌরব হারিয়ে ফেলেছিল । রাজধানীর স্থানান্তর প্রসঙ্গে ডক্টর হাসান মন্তব্য করেছেন যে দৌলতাবাদ ছিল মোহাম্মদ বিন তুঘলকের দ্বিতীয় রাজধানী দিল্লি শহর কখনোই পরিত ্যক্ত করা হয়নি শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল ও টাকশাল দিল্লিতে উপস্থিত ছিল । ঐতিহাসিক লেন্দফুল মন্তব্য করেছেন যে, "দৌলতাবাদ ছিল বিপথগামী শক্তির স্মারক"
শেষ পর্যন্ত মহম্মদ বিন তুঘলকের দেবগিরিতে রাজধানীর স্থাপনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল ৷ কারণ, সুলতানের রাজধানীর স্থাপনের পদ্ধতির সময়কাল ও লক্ষ্য সুনিশ্চিত ছিল না । রাজধানীর স্থানান্তরের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও তার সুদূরপ্রসারী সুফল লক্ষ্য করা যায় । এর ফলে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে এক নতুন সংস্কৃতির জন্ম হয় ৷ এই এত ভালো পরিকল্পনা শুধুমাত্র তার দূরদৃষ্টিকতার অভিভাবক বিফল হয় ৷