অভ্যন্তরীণ সংকট না দূরপাল্লার বাণিজ্য সামন্ততন্ত্রের পতনের জন্য কোনটা দায়ী ছিল অথবা,অভ্যন্তরীণ স্ববিরোধ না দূরপাল্লার বাণিজ্য-সামন্ততন্ত্রের পতনের জন্য কোনটি বেশী দায়ী ছিল
এক বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বহিরাগত এবং আরবীয় মুসলমানদের আক্রমণে ইউরোপ মহাদেশ বারেবারে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকলে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন শার্লামেন । আর এই সময় থেকেই ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের পরিক্রমণ চলে ৷ ত্রয়োদশ থেকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্রমশ অবক্ষয়ের দিকে যাত্রা শুরু করে এই অবক্ষয়ের পশ্চাতে ঐতিহাসিক এবং গবেষকরা একাধিক কারণ কে চিহ্নিত করেছেন ৷ যে কারণগুলিকে মূলত অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক এই দুই ভাগেই ভাগ করা যায় ৷
Related Posts
অভ্যন্তরীণ কারণ গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল কৃষি ব্যবস্থায় সামন্ত প্রভুর কোন নতুনত্ব বা অভিনত্ব আনতে না পারার উৎপাদন ব্যবস্থা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হয় । সামন্ততন্ত্রের প্রথম পর্যায়ে প্রজার সঙ্গে সামন্ত প্রভুর পিতার ন্যায় পুত্রের যে সম্পর্ক ছিল পরবর্তী সেই সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায় শাসক এবং শাসিত সম্পর্ক ৷ আঞ্চলিক প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে যে যে সামন্ততান্ত্রিক গড়ে উঠেছিল তা একান্ত ভাবে "Localized Economy" পরিণত হয় ৷ এই সকল কারণ সামন্ত ব্যবস্থাকে ভিতর থেকে দুর্বল করে পাশাপাশি যোগাযোগের ব্যবস্থার বিকাশ নগরের সংখ্যা বৃদ্ধি বিকল্প অর্থনীতি হিসেবে শিল্পের উদ্ভব এক বাণিজ্য সম্প্রসারণ এর আবির্ভাব বাহ্যিক এই সকল কারণ গুলি সামন্ত কাঠামোতে আঘাত আনে বাইরের দিক থেকে ৷
ত্রয়োদশ শতকে সামন্ত ব্যবস্থার প্রতি মানুষ ক্রমশ রুষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে ৷ মরিস ডবের মতে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছিল সামন্ত প্রভুদের অতিরিক্ত শোষণজনিত কারণে ৷ চতুর্দশ শতক থেকে সামন্ত প্রভুরা জমিদারদের ওপর শোষণের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করে ৷ আর এই শোষণের ফলে সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে ভূমিদাসদের বিভিন্ন জায়গায় অভ্যুত্থান ঘটতে থাকে তার মধ্য দিয়ে সামন্ততন্ত্র ভেঙে পড়ে ৷
চতুর্দশ শতকে পরপর ঘটতে থাকা প্লেগজনিত মহামারী বা ব্ল্যাক ডেথ ইউরোপের সামগ্রিক ব্যবস্থার ওপর অত্যন্ত ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে ৷ শহর নগরজুড়ে মহামারীর দরুণ বিপুল সংখ্যক মানুষ এর মৃত্যু হয়। কোথাও কোথাও মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মারা যায়। এই সংকটের পাশাপাশি সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ,ইংল্যান্ডের কৃষক বিদ্রোহ,ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধ, জার্মানির কৃষক বিদ্রোহ প্রকৃতি ঘটনাগুলি সামন্ততন্ত্রের অভ্যন্তরীণ কাঠামোকে প্রচন্ডভাবে দুর্বল করে দেয় ৷
জনসংখ্যার গতি বা প্রকৃতি পরিবর্তন সামন্ত ব্যবস্থার অন্তদ্বন্দ্বকে বাড়িয়ে দেয় ৷ জনসংখ্যা বৃদ্ধি জনিত কারণে দ্রব্যমূল্য কমে যাওয়ার ফলে দরিদ্র কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৷ কিন্তু পরবর্তীকালে জনসংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকে পরপর যুদ্ধ এবং মহামারীজনিত কারণে জনসংখ্যা হ্রাসের ফলে মানুষ ও জমির অনুপাতের পরিবর্তন ঘটে ৷ সামন্ত প্রভুরা শোষণের শত চেষ্টা করলেও ক্রমাগত ভূমিদাস প্রথার অবসান ঘটতে থাকে ৷ ফলে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি তীব্র সংকটের মধ্যে পড়ে ৷
ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের শহরের পতন সামন্ত ব্যবস্থা ভাঙ্গনের একটি অন্যতম কারণ ৷ এছাড়া যুদ্ধের কলাকৌশল এক লাফে অনেকটা পরিবর্তিত হয় । আধুনিক যুদ্ধ শিক্ষায় প্রশিক্ষিত পদাতিক সৈন্যবাহিনী সামন্তদের পুরাতন যুদ্ধ কৌশল ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে ৷ আবার অনেকের মধ্যে আলোচ্য পর্বে অভিজাত পরিবার আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছিল কিন্তু উৎপাদন বাড়েনি ৷ ফলে সামন্ততন্ত্রের অন্তবিরোধ মারাত্মক আকার ধারণ করে ৷ যার ফলে সামন্ততন্ত্র ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে ৷
তবে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ পল সুইজি সামন্ততন্ত্রের পতনের জন্য দূর বাণিজ্যকেই চিহ্নিত করেছেন ৷ তিনি বলেছেন সামন্ততান্ত্রিক অর্থনৈতিক অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল একটি নিগম পথহীন অর্থনীতি এখানে উৎপাদনের উদ্দেশ্য ছিল পুরোপুরি নিজস্ব প্রয়োজনে তাগিদে । যখনই এহানো প্রয়োজন স্বতন্ত্র ছিল তখনই সামন্ততন্ত্রকে শিথিল ও দুর্বল করে দেয় ৷ পল সুইজি আরো বলেন ব্যবসা-বাণিজ্যের বিপুল পতনের বিনিময়ে অর্থনীতি আবির্ভূত হলে ম্যনারের সীমাবদ্ধতা উৎকৃষ্ট হয়ে ওঠে, ব্যাপক রূপান্তরের জন্য ম্যনার উৎপাদন পদ্ধতির সম্ভব ছিল না। ফলত সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি অসম্পূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা প্রকৃষ্ট রূপ ধারণ করেছিল যা এই ব্যবস্থার পতন কে ত্বরান্বিত করেছিল ৷
পল সুইজির মতে দূর বাণিজ্যের মধ্যে দিয়ে বাণিজ্য পদগুলিকে কেন্দ্র করে একাধিক নতুন নতুন নগরের পত্তন ঘটতে থাকে ৷ এই নগর গুলিতে একাধিক শিল্প বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে ৷ গ্রাম এবং কৃষি অর্থনীতি ভিত্তিক সামন্ততন্ত্র পতনের দিকে ঢেলে দেয় এই সময় জেন্ট্রি শ্রেণীর উত্থান এক দিকে যেমন বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কে বাড়িয়েছিল তেমনি সামন্ত অর্থনীতির মৃত্যু পরয়ানা শুনিয়ে দিয়েছিল ৷
উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে অভ্যন্তরীণ ও দূর বাণিজ্য কোনোটাকে একক ভাবে দায়ী করা যুক্তিযুক্ত হবে না ৷ বরং বলা যায় উভয় সংকটে সামন্ততন্ত্রের পতন কে ত্বরান্বিত করে ৷ সামন্ততন্ত্রের পতনের পাশ্চাত্যে একাধিক কারণ দায়ী থাকলেও সামন্ততন্ত্রের প্রকৃতগত ও সংগঠনিক পরিবর্তন ক্রমশ রাজশক্তিতে পরক্রমশালী হয়ে উঠলে সামন্ত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে ৷