সমুদ্রগুপ্তের দাক্ষিণাত্যনীতি ব্যাখ্যা করো অথবা, দক্ষিণ ভারতে সমুদ্রগুপ্তের সাফল্যের মূল্যায়ন করো।

সমুদ্রগুপ্তের দাক্ষিণাত্যনীতি ব্যাখ্যা করো অথবা, দক্ষিণ ভারতে সমুদ্রগুপ্তের সাফল্যের মূল্যায়ন করো।

 সমুদ্রগুপ্তের দাক্ষিণাত্যনীতি ব্যাখ্যা করো অথবা, দক্ষিণ ভারতে সমুদ্রগুপ্তের সাফল্যের মূল্যায়ন করো।

উত্তর ভারতে কুষাণদের রাজনৈতিক আধিপত্য খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের দ্বিতীয় বল থেকে ক্ষয়িত্ব হতে হতে শেষপর্যন্ত আনুমানিক ২৬২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে বা। এর আরও অর্ধ শতাব্দী পরে উত্তর ভারতে গুপ্তশক্তির উত্থান লক্ষ করা যায়। গাঙ্গেয় অতলভূমিতে একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকে পর্যদুস্ত করে গুপ্তবংশীয় শাসকগণ তাদের অধিপত্য বিস্তার করেছিল। এই বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও লিজ্জবী বংশীয় এজকন্যা কুমারদেবীর পুত্র হলেন সমুদ্রগুপ্ত। এইজন্য সমুদ্রগুপ্ত নিজেকে 'লিচ্ছবী-দৌহিত্র' যার উল্লেখ করেছেন। অসামান্য প্রতিভার অধিকারী সমুদ্রগুপ্ত সমগ্র প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল স্থান দখল করে আছেন। তাঁর সভাকবি হরিষেণ রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তি' থেকে তাঁর সামরিক প্রতিভা ও রাজত্বকালের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পাওয়া যায়। এছাড়াও 'এরাণ লেখ', মুদ্রা, ও চৈনিক বিবরণ থেকে তাঁর রাজত্বকাল সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়।


সিংহাসন আরোহণ করেই তিনি দিগ্বিজয়ীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি আর্যাবর্ত ও যক্ষিণাত্যের বিস্তীর্ণ স্থানে রাজ্যজয় করেন। ড. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী বলেন যে, সমুদ্রগুপ্ত নিজেকে 'এবারাট' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল ভারতের হজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। কারণ ধর্মশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, শক্তিশালী রাজাদের কর্তব্যই হল ভারতভূমির ঐক্য প্রতিষ্ঠা। ড. রোমিলা থাপারের মতে, তাঁর রাজ্যজয়ের উদ্দেশ্য ছিল রায়না ধর্মের প্রসার ও সাম্রাজ্যবাদ। তবে ড. গয়াল বলেন যে, দক্ষিণ ভারতের অপরিমিত সম্পদ আহরণ করে একটি বিশাল সেনাদল পোষণ এবং মগধের দরবারের বৈভব বৃদ্ধিই তাঁর লক্ষ্য ছিল।


'এলাহাবাদ প্রশস্তি' থেকে জানা যায় যে, প্রথমে তিনি আর্যাবর্তের ৯ জন রাজাকে উত্তুলিত করেন। এরপর তিনি বর্তমান গাজিপুর থেকে জব্বলপুর পর্যন্ত বিস্তৃত অরণ্যসংকুল অঞ্চলের আটবিক রাজ্যগুলি জয় করে নিজ রাজ্যভুক্ত করেন। এরপর তিনি ভারতের পূর্ব উপকূল ধরে দাক্ষিণাত্য জয়ে অগ্রসর হন এবং দাক্ষিণাত্যের ১২ জন রাজাকে পরাজিত করেন। 'এলাহাবাদ প্রশস্তি' অনুসারে যাদের পরিচয় হল- (১) কোশলের মহেন্দ্র য়র অবস্থান বর্তমান ছত্রিশগড়ের 'রায়পুর', 'সম্বলপুর' ও 'বিলাসপুর' অঞ্চলে। (২) মহাকাস্তারের ব্যাঘ্ররাজ এটি সম্ভবত বর্তমান বস্তার অঞ্চল। (৩) কেরিলের মন্তরাজ ইনি অস্ত্রপ্রদেশের পশ্চিমে গোদাবরী জেলার কোল্লার হ্রদ এলাকার শাসক। (৪) পৃষ্ঠপুরের মহেন্দ্রগিরি এটি পূর্ব গোদাবরী জেলার পিঠাপুরমের সমর্থক। (৫) কোট্রুরের স্বামীদত্ত গুটিশার দক্ষিণতম প্রান্তে গঞ্জাম জেলার কোটুর-এর শাসক। (৬) এরান্ডপল্লীর দমন এটি পশ্চিম গোদাবরী জেলায় অবস্থিত। (৭) কাঞ্চীর বিষুগোপ তামিলনাড়ুর দক্ষিণে বিখ্যাত নগর কান্তীপুরম, বিষুগোপ নিঃসন্দেহে পল্লব বংশীয় রাজা ছিলেন। (৮) অবমুক্তার নীলরাজ এট অল্পপ্রদেশের অনন্তপুর জেলায় অবস্থিত। (৯) বেশীর হস্তিবর্মন-এটি গোদাবরী ও কয়ার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত। হস্তীবর্মন সম্ভবত সালঙ্কায়ণ বংশস্তুত রাজা ছিলেন। (১০) পালঙ্কের উগ্রসেন ইনি সম্ভবত অন্দ্রপ্রদেশের নেল্লোর অঞ্চলের শাসক। (১১) দেবরাষ্ট্রের কুবের। (১২) কুস্থলপুরের ধনঞ্জয়-ইনি সম্ভবত অল্পপ্রবেশের বেশের পশ্চিমাঞ্চলে ক্ষমতাসীন ছিলেন।


দাক্ষিণাত্য অভিযানের দ্বারা সমুদ্রগুপ্তের সামরিক সাফল্য পল্লব রাজত্ব পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। এই অভিযানের সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হল তিনি পরাজিত দ্বাদশ রাজ্যগুলি গ্রাস না করে তাদের মুক্তি দেন অর্থাৎ, স্থানীয় এলাকায় পুনঃস্থাপিত করেছিলেন যা গ্রহণ মোক্ষ অনুগ্রহ নীতি নামে পরিচিত। উত্তর ভারতে তার যে আগ্রাসী নীতি লক্ষ করা যায় দাক্ষিণাত্যে তার অনুরুপ প্রয়োগ নেই। কালিদাসের 'রঘুবংশে' পরাজিত শাসকদের রাজ্য প্রত্যার্পণ করার নীতি 'ধর্মবিজয়' বলে অভিহিত। তবে এই ধর্মবিজয় নীতি নিঃসন্দেহে অশোকের ধর্মবিজয়ের ধারণা থেকে পৃথক।


সমুদ্রগুপ্ত কেন এমন বিচিত্র নীতি গ্রহণ করেছিলেন তার ব্যাখ্যা সমকালীন তথ্যসূত্রে নেই। বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে নানাপ্রকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। একটি ব্যাখ্যা হল সমুদ্রগুপ্তের অভিযান অপ্রতিহতভাবে কান্তী পর্যন্ত পৌঁছনোর পর পল্লব বিষুগোপের নেতৃত্বাধীন একটি গোষ্ঠীর হাতে গুপ্তবাহিনী পরাজিত হয়। সমুদ্রগুপ্ত বিজিত এলাকা গ্রাস করতে অসমর্থ হন। সেই কারণে গ্রহণ মোক্ষানুগ্রহ নীতির প্রয়োগ ঘটে। কোনো কোনো পণ্ডিত অভিমত দিয়েছেন যে, হরিষেণ প্রথমে উত্তর ভারতের পরাজিত ৩ জন রাজার উল্লেখ করেন। তারপর আসে দাক্ষিণাত্য অভিযানের বর্ণনা এবং সবশেষে আর্যাবর্তের ৯ জন রাজার তালিকা এই বর্ণনা যদি ঘটনাক্রমের দিকে ইঙ্গিত দেয় তাহলে সমুদ্রগুপ্ত উত্তর ভারতে সামরিক সাফল্যের পর সুদৃঢ় দাক্ষিণাত্য অভিযান করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে উত্তর ভারতের প্রতিরক্ষা বৈরী হয়ে উঠলে, তিনি দাক্ষিণাত্য অভিযান কার্যত অসমাপ্ত রেখে উত্তর ভারতে ফিরে আসেন এবং উত্তর ভারতের ৯ জন রাজাকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। অর্থাৎ উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিকূলতার দরুণ সমুদ্রগুপ্ত দাক্ষিণাত্যে গ্রহণ মোক্ষাণুগ্রহের মতো অপেক্ষাকৃত নরম নীতি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।


দাক্ষিণাত্য অভিযানে সমুদ্রগুপ্ত প্রধানত আগ্রহী ছিলেন। ওডিশা, অন্ধ্র ও তামিলনাড়ুর পূর্ব উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলি যার মধ্যে কুয়া ও গোদাবরীর বদ্বীপ এলাকাও অন্তর্ভুক্ত। এই এলাকায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের অস্তিত্ব সুবিদিত। সমুদ্রগুপ্ত শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলির সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্রিয় ছিলেন এমন সান্ধ এলাহাবাদ প্রশস্তিতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ, বাণিজ্যসমৃদ্ধ পূর্ব উপকূলের প্রতি আকর্ষণর সমুদ্রগুপ্তকে দাক্ষিণাত্য অভিযানে উৎসাহিত করেছিল। সেই কারণেই সমুদ্রগুপ্ত দাক্ষিণাত্যে ভূখণ্ড সম্প্রসারণ ঘটাতে উদ্যোগী না হয়ে গ্রহণ মোক্ষাণুগ্র নীতি নিয়ে থাকতে পারেন।


দিগ্বিজয়ের শেষে সমুদ্রগুপ্ত অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন এবং সার্বভৌম শক্তির অধিকারী হিসেবে তিনি 'পরক্রমাঙ্ক', 'সর্বরাজোচ্ছেত্তা', 'অপ্রতিরণ' প্রভৃতি উপাধি ধারণ করেন। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ তাঁকে 'ভারতীয় নেপোলিয়ান' বলে আখ্যায়িত করেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, সমুদ্রগুপ্ত ভারত ইতিহাসে একজন উল্লেখযোগ্য ও চমতপ্রদ ভাই। ভারত ইতিহাসে তিনি এক নবযুগের উদ্বোধন করেছিলেন। বৈদেশিক শাসন ও একাংখা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের অস্তিত্বের ফলে ভারতের রাজনৈতিক ঐকা যখন বিনষ্ট, কেন এক অবস্থায় সমুদ্রগুপ্ত সামরিক বলের দ্বারা ভারতের এক বিস্তীর্ণ স্থানে একনেতিক ঐকা স্থাপন করেন। সামরিক বলের মোহে অন্ধ হয়ে দূরবর্তী অঞ্চলের একাপলিকে তিনি কক্ষিগত করেননি বরং তাদের স্বশাসনের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে নিজ উষ্ণতা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। কেবলমাত্র যোদ্ধা ও সুশাসক হিসেবেই না. ববি, সঙ্গীতজ্ঞ, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ও শিক্ষা সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও উনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। গুপ্তযুগে বৌদ্ধিক ও জাগতিক সমৃদ্ধির যে চরম বিকাশ রেলক্ষিত হয়। তার সূচনা হয়েছিল সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালেই। এই কারণে ঐতিহাসিক আরাখলে তাকে 'প্রাচীন ভারতীয় সুবর্ণ যুগের অগ্রদূত' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।



About the author

Irisha Tania
"আমি সেই মেয়ে, যে শব্দে বাঁচে। কলম আমার অস্ত্র, আর কাগজ আমার স্বপ্নের আকাশ। প্রতিটি অনুভব, প্রতিটি চিন্তা আমি সাজিয়ে রাখি অক্ষরের গাঁথুনিতে। কখনো গল্পে, কখনো কবিতায়, আবার কখনো নিঃশব্দের ভেতরে। আমি লিখি, কারণ লেখার মাঝে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। …

Post a Comment

🌟 Attention, Valued Community Members! 🌟